Header Ads Widget

WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা ** WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা **

ticker

6/recent/ticker-posts

আমার জীবন - রাসসুন্দরী দাসী (গ্রন্থপরিচয়)

 আমার জীবন 
রাসসুন্দরী দাসী 
আমার জীবন - রাসসুন্দরী দাসী

[বাংলা সাহিত‍্যে প্রথম আত্মজীবনী রচয়িতা হলেন – শ্রীমতী রাসসুন্দরী দাসী। গ্রন্থটির নাম হল – ‘আমার জীবন’। গ্রন্থটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩১৩ বঙ্গাব্দে। এই তৃতীয় সংস্করণে রাসসুন্দরী দেবীর লেখা আত্মজীবনীটির সঙ্গে আত্মজীবনীটির সম্পর্কে জ‍্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও দীনেশচন্দ্র সেনের রচনাও প্রকাশিত হয়। আমার জীবন’ গ্রন্থের দুটি ভাগ – প্রথম ভাগে জীবনকথা বর্ণিত, দ্বিতীয় ভাগে ভগবৎ বন্দনা বর্ণনা আছে। গ্রন্থের প্রথম ভাগে মঙ্গলাচরণ ও ১৬টি রচনা এবং দ্বিতীয় ভাগে আছে ১৫টি রচনা ও মনশিক্ষা। শ্রী জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গ্রন্থের সম্পর্কে যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “ইহার জীবনের ঘটনাবলী এমন বিস্ময়জনক এবং ইহার লেখায় এমন একটি অকৃত্রিম সরল মাধুর্য আছে যে, গ্রন্থখানি পড়িতে বসিয়া শেষ না করিয়া থাকা যায় না।” এই পর্বে দেওয়া হল এই জীবনীগ্রন্থটি সম্পর্কে দীনেশচন্দ্র সেন-এর রচনাটি। ]

গ্রন্থপরিচয় অংশ - দীনেশচন্দ্র সেন 

গ্রন্থপরিচয়

গ্রন্থকর্ত্রী মুখবন্ধে লিখিয়াছেন, “১২১৬ সালে চৈত্র মাসে আমার জন্ম হয়, আর এই ১৩০৩ সালে আমার বয়ঃক্রম ৮৮ বৎসর হইল।”

এই জীবনখানি ব্যক্তিগত কথা বলিয়া উপেক্ষা করা চলে না। ইহা প্রাচীন হিন্দু রমণীর একটি খাঁটি নক্সা। যিনি নিজের কথা সরল ভাবে কহিয়া থাকেন, তিনি অলক্ষিতভাবে সামাজিক চিত্র অঙ্কন করিয়া যান। আমার জীবন পুস্তকখানি শুধু রাসসুন্দরীর কথা নহে, উহা সেকেলে হিন্দু রমণীগণের সকলের কথা; এই চিত্রের মত যথাযথ ও অকপট মহিলা-চিত্র আমাদের বাঙ্গালা সাহিত্যে আর নাই। এখন মনে হয়, এই পুস্তকখানি লিখিত না হইলে বাঙ্গালা সাহিত্যের একটি অধ্যায় অসম্পূর্ণ থাকিয়া যাইত।

হিন্দু সমাজে পুরমহিলারা যেখানে অবস্থিত ছিলেন, এখন আর তিনি সেখানে নাই, এই হিসাবে এই চিত্রখানি অমূল্য। রাসসুন্দরী বা তাঁহার মত আর কেহ জীবনের শেষ সীমান্তে দীড়াইয়া একথা না বলিয়া গেলে যাহা আর বলা হইত না। সেকেলে রমণীচরিত্র ভয়, লজ্জা ও গ্রাম্য সংস্কারের মধ্যে কিভাবে বিকাশ পাইত, তাহার এমন সুস্পষ্ট ও জীবন্ত ছবি আমরা আর দেখি নাই। পল্লীরমণীর একহস্ত পরিমিত অবগুন্ঠন কিরূপে প্রৌবয়সে সীমন্তের সিন্দুর স্পর্শ করিয়া তাহার অন্নপূর্ণা মূর্তি উন্মোচন করিয়া দেখাইত, কন্যা হইতে বধূ, বধু হইতে গৃহিণী   জননীরূপে তিনি কিরূপে বিকাশ পাইতেন তাহা এমন বিশ্বস্তসূত্রে আমাদের আর জানিবার উপায় ছিল না।

সাধারণতঃ কবিগণ প্রেকে কেন্দ্রবর্তী করিয়া রমণী চরিত্র আঁকিয়ে থাকেন, কিন্তু হিন্দুর গৃহ শুধু পতিপত্নীর নিজস্ব গৃহ নহে; যিনি গৃহিণী, তিনি কন্যা, গ্নী, ননদী, পুত্রবধূ, কর্ত্রী এই সর্ববিধরূপে সুযশ অর্জন না করিতে পারিলে এই সমাজে তিনি প্রশংসা পাইতেন না, অথচ কবিগণ সচরাচর তাঁহাকে এই গণ্ডি হইতে পৃথক করিয়া প্রেমলীলার স্বাতন্ত্র্য কল্পনা করিয়া থাকেন, রমণীর সমগ্র চিত্রটি আমরা প্রায়ই কাব্য বা উপন্যাসে দেখিতে পাই না। স্বাভাবিক লজ্জাশীলতায় রাসসুন্দরী এই প্রেমের অঙ্কটিই স্বজীবন হইতে বাদ দিয়াছেন, তাঁহার জীবনের অপরাপর দিক দ্বিগুণতর স্পষ্ট হইয়া উঠিয়াছে। কবি বা পন্যাসিক যে স্থান হইতে বিদায় গ্রহণ করিয়া থাকেন, রাসসুন্দরী সেই স্থান হইতে কথা আরম্ভ করিয়াছেন, কোন পুরুষ শত প্রতিভাবলেও রমণীহৃদয়ের গূঢ় কথার এমন আভাস দিতে পারিতেন কিনা সন্দেহ।

সেকেলে রমণী সমাজের সম্পূর্ণ বশ্য ছিলেন। কে কি বলিবে, এই ভয় তাহার চিত্তে যেরূপ প্রবল ছিল, এই স্বেচ্ছাতন্ত্রযুগে তাহার একটা পরিমাণ করা যায় না। শুধু কে কি বলিবে তাহা নহে, কে তাহার মুখখানি দেখিয়া ফেলিবেনিন্দুকের জিহ্বা নাচিয়া উঠিবে, এই লজ্জায় তিনি অবগুষ্ঠনবতী হইয়া যেভাবে লুকাইয়া থাকিতেন তাহা এখন কল্পনা করা সহজ নহে। তিনি লেখাপড়ার চর্চা করেন, এ কথা শুনিলে গুরুজনের গণ্ড লজ্জায় রক্তিমাভ হইয়া উঠিত, ক্ষুধিত হইলে তিনি চাহিয়া খাইতে পারিতেন নাবধূবেশী হিন্দু রমণী সহিষ্ণুতা ও ত্যাগশীলতার একখানি মৌন ছবিবিশেষ ছিলেন। এই প্রকার অবস্থা সমূহ অতিক্রম করিয়া বার্ধক্যে উপনীত একজন হিন্দু-রমণী কিভাবে চিন্তা করিয়াছেন, তাঁহার ধর্মভাব কি প্রকার, তাঁহার মন কি ছন্দে গড়াইহা জানিতে স্বভাবতই কৌতূহল জন্মিবার কথা, এই কৌতূহল রাসসুন্দরী অপর্যাপ্তরূপে চরিতার্থ করিয়াছেন।

এখন আমরা তাহার জীবনের কিছু আভাস দিতে চেষ্টা করিব। অমরকোষে রমণীর আর একটি প্রতিশব্দ ভীরু। এই নাম কিরূপ সার্থক, তাহা রাসসুন্দরীর জীবনে সুস্পষ্টরূপে দৃষ্ট হইতেছে। বাল্যকালে ভয় তাঁহাকে একবারে অভিভূত করিয়া রাখিয়াছিল। বালিকা শুনিয়াছিল, যদি কেহ কাহাকে মারে তবে তাহাকে ছেলেধরায় লইয়া যায়। এই ছেলেধরার ভয়ে রাসসুন্দরী দিনরাত আস্থির থাকিতেন।— “আমাকে যখন কোন ছেলে মারিত, তখন ভয়ে আমি বড় করিয়া কাঁদিতাম না, উহাকে ছেলেধরায় লইয়া যাইবে, কেবল এই ভয়ে আমার দুই চক্ষু দিয়া জল পড়িত।” অনেক সময় ছেলেধরার কথা মনে হওয়ামাত্র তাঁহার দুইচক্ষু জলপূর্ণ হইত, এই অবস্থায় এক সঙ্গিনী একদিন আসিয়া বলিল,— “উনি একটি সোহাগের আরশি, কিছু না বলিতেই কাঁদিয়া উঠেন, এই বলিয়া আমার মুখে একটা ঠোক্না মারিল।” একদিন একজন গো-বৈদ্য দেখিয়া ছেলেধরা ভাবিয়া “ভয়ে এককালে মৃতপ্রায় হইলাম, তখন আমার মনে এত ভয় হইয়াছিল যে, আমি দুই হাত দিয়া চক্ষু ঢাকিয়া থর থর করিয়া কাঁপিতে লাগিলাম।” শুধু ছেলেধরার ভয় নহে, একদিন দুইটি ছোট ভাই সহ নদীর ঘাটে যাওয়ার পর একটি ভাই বলিল, — “দেখিতেছি এসকল শ্মশান, মড়ার বিছানা পড়িয়া আছে। এ মড়ার নাম শুনামাত্র আমার অত্যন্ত ভয় হইল, সে ভয় যেন হাঁ করিয়া আমাকে গ্রাস করিতে আসিল।” প্রৌঢ় বয়সের প্রসঙ্গে রাসসুন্দরী ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়া লিখিয়াছেন,— “আমার মন সর্বদা ভয়ে কম্পিত হইত, সে ভয় আমার মনে কে দিয়াছিল, আবার কাহার বল অবলম্বন করিয়াই বা সে ভয় পরাস্ত হইল?”

কেহ মারিলে বালিকা ভয়ে কিছুই বলিত না, “ সকলে জানিত, আমাকে মারিলে আমি কাহারও নিকট বলিব না, আমি সকল বালিকাকে ভয় করিতাম, এজন্য গোপনে গোপনে সকলে আমায় মারিত।” একদিন একটি সঙ্গিনী-বালিকা রাসসুন্দরীর ছেলে সাজিয়া তাহাকে ঠকাইয়া তাহার সমস্ত ফল ও জলপান খাইয়া ফেলিল এবং বলিল, “আমাকে আঁচাইয়া দাও।” জল না পাওয়াতে সে সঙ্গিনীর আদেশ পালন করিতে পারিল না— “আমার সঙ্গিনী এই অপরাধে আমাকে একটি চড় মারিল, আমি মার খাইয়া ভয়ে কাঁপিতে লাগিলাম। আমার দুই চক্ষে জল পড়িতে লাগিল। এই সময়ে আমার খেলার সাথী আর একটি বালিকা সেইস্থানে ছিল, সে উহাকে বলিল, তুমি কেমন মেয়ে, উহার সকল জলপান খাইয়া ফেলিলে, আম দুটাও খাইলে, আবার উহাকে কান্দাইতেছ? আমি গিয়ে উহার মায়ের কাছে বলিয়া দিই।” এই কথা শুনিয়া বালিকা আরও বিচলিত হইয়া পড়িল। এই সকল বালসুলভ শত শত অকথার মধ্যে রাসসুন্দরীর যে মূর্তিটি চিত্রিত হইয়াছে, তার চিরসহিষ্ণু, ক্ষমাশীল বঙ্গমহিলারই আদত ছবি। রাসসুন্দরী পরমাসুন্দরী ছিলেন, অষ্টাশী বৎসর বয়সে তাহা জানাইতে তিনি কোন সঙ্কোচবোধ করেন নাই।

রাসসুন্দরী নিজের দোষের অংশ বাদ দিয়া শুধু গুণের ভাগ দেখাইয়া যান নাই। তিনি পুস্তকের এক স্থানে ভগবানের নিকট প্রার্থনা করিতেছেন— “আমি যদি আপনার নিন্দিত কর্ম বলিয়া কিছু গোপন করিয়া থাকি তাহা তুমি প্রকাশ করিয়া দাও। আমার যে কথা স্মরণ না থাকে তাহা তুমি আমাকে স্মরণ করাইয়া দাও। আমি যে প্রবঞ্চনা করিয়া কোন কর্ম করিব বা, কথা বলিব, এমন চেষ্টা আমার কখনই নাই।”

শৈশবে সকলে তাহাকে বোকা-মেয়ে বলিয়া ডাকিত। বস্তুত পঁচিশ বৎসর বয়সেও তিনি এমন সকল কার্য করিয়াছেন, যাহাতে আমাদের হাস্যের উদ্রেক করেসে সকল কথা তিনি অকপটে লিখিয়া গিয়াছেন। একদিন নদীতীরে দুইটি ভাই সহ বালিকা বড় বিপন্ন হইয়াছিল; মাতা শিখাইয়াছিলেন, “বিপদে পড়িলে দয়ামাধবকে ডাকিও।” দয়ামাধব সেই বাড়ীর স্থাপিত বিগ্রহ। সেইদিন আর্ত হইয়া বালিকা বলিল, ‘দাদা দয়ামাধবকে ডাক। তখন আমরা তিনজনে দয়ামাধব! দয়ামাধব! বলিয়া উচ্চৈঃস্বরে ডাকিতে লাগিলাম। সেই সময়ে জনৈক পথিক তাহাদিগের চীৎকার শুনিয়া দয়া পূর্বক তাহাদিগকে বাড়ীতে পৌছাইয়া দেয়। পরদিন বালিকা কথা-প্রসঙ্গে ছোট ভাইকে বলিল, “হাঁ দয়ামাধব আমাদের কোলে করিয়া বাড়ীতে আনিয়াছেন।” ইহা শুনিয়া আমার ছোট ভাই বলিল,— “ছি! দিদি কি বলিলে? দয়ামাধব কি মানুষ, দয়ামাধবের মুখে কি দাড়ি আছে?” এই বিষয়টির মীমাংসার জন্য মাতৃসকাশে উপস্থিত হইলে মাতা হাসিয়া রাসসুন্দরীকে বলিলেন,— “তোমার ছোটভাই যে সকল কথা বুঝে, তোমার বুদ্ধি নাই, তুমি কিছুই বুঝ না।”

এই সময়ে বালিকা মাতার নিকট পরমেশ্বর কিরূপে সাহায্য করেন, তাহার কথা শুনিয়াছিলেন, সেই কথায় তাঁহার যে বিশ্বাস হইয়াছিল, তাহাই তাহার ভাবী জীবনকে সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত ও নিয়মিত করিয়াছিল। মা তাহাকে বলিয়াছিলেন,— “দয়ামাধব তোমাদের কান্না শুনিয়া মানুষ পাঠাইয়া দিয়া তোমাদিগকে বাটিতে আনিয়াছেন।”

নিজের নির্বুদ্ধিতার কথা তিনি আরও অনেক স্থলে সরলভাবে কহিয়া গিয়াছেন— “যখন আট নয় বৎসরের ছিলাম, তখন আমাকে কত লোক পরিহাস করিয়া বলিত, তোমার মায়ের বিবাহ হয় নাই। আমার বুদ্ধি এমনই ছিল, আমি সেই কথায় বিশ্বাস করিতাম। পরে তখন আমার পঁচিশ বৎসর বয়ঃক্রম তখনই সেই বুদ্ধির শিকড় কিছু কিছু ছিল।” তাহার শ্বশুর বাড়ীতে একটা ঘোড়া ছিল তাহার নাম জয়হরি। একদিবস আমার বড় ছেলেটিকে ঘোড়ার উপর চড়াইয়া বাটীর মধ্যে আমাকে দেখাইতে আনিল। তখন সকল লোকে বলিল, এ ঘোড়াটি কর্তার; তখন আমাকে সকলে বলিতে লাগিল, দেখ, দেখ, ছেলে কেমন করিয়া ঘোড়ায় চড়িয়া আসিয়াছে দেখ। আমি ঘরে থাকিয়া জানিলাম ওটা কর্তার ঘোড়া, সুতরাং মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম যে, কর্তার ঘোড়ার সম্মুখে আমি কেমন করিয়া যাই, ঘোড়া যদি আমাকে দেখে তবে বড় লজ্জার কথা।”

দ্বাদশ বর্ষ বয়সে রাসসুন্দরী বিবাহ হয়, তখনও তিনি বিবাহ কি ভাল জানিতেন না। তিনি বড়ই সোহাগে পালিতা। একদিন শুনিলেন তাঁহার জননী তাঁহাকে অপরের হস্তে দিবেন। বালিকার বড় অভিমান হইলএই কথা বড় দুঃসহ হইল। তিনি মাকে যাইয়া বলিলেন, “মা আমাকে যদি কেহ চাহে, তবে কি তুমি আমাকে দেবে?” মা বলিলেন, “ষাট তোমাকে কাহাকে দিব, এ কথা তোমাকে কে বলিয়াছে?” কিন্তু বিবাহের আয়োজন হইল, বালিকা বেশ স্ফূর্তি বোধ করিল। হুলুধবনি, বাজনা, হলুদমাখা, এ সকল আনন্দের মধ্যে যে তাহাকে চিরদিনের জন্য মাতার ক্রোড় হইতে কাড়িয়া লইবার ব্যবস্থা হইতেছে, তাহা সে জানিত না। বিবাহান্তে বরপক্ষ বাড়ীতে ফিরিয়া যাইবে, খুব ধুমধাম পড়িয়া গেছে— “তখন আমি ভাবিলাম, ঐ যাহারা আসিয়াছিল, এখন বুঝি তাহারাই যাইতেছে। এই ভাবিয়া আমি অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া মায়ের সঙ্গে বেড়াইতে লাগিলামদেখিলাম কতক লোক আহ্লাদে পূর্ণ হইয়াছে, কতক লোক কাঁদিতেছে, উহা দেখিয়া আমার প্রাণ চমকিয়া উঠিল। ক্রমে আমার দাদা, খুড়ী, পিসী এবং মা প্রভৃতি সকলেই আমাকে কোলে করিয়া কাঁদিতে লাগিল।

“ঐ সকল কান্না দেখিয়া আমিও কাঁদিতে লাগিলাম, ঐ সময়ে আমি নিশ্চয় জানিলাম যে, মা আমাকে এখনই দিবেন। তখন আমি মায়ের কোলে গিয়া মাকে আঁটিয়া ধরিয়া থাকিলাম, আর মাকে বলিলাম— “মা তুমি আমাকে দিও না।”— আমার এ কথা শুনিয়া, এই প্রকার ব্যবহার দেখিয়া এ স্থানের সকল লোক কাঁদিতে লাগিল। আমার মা আমাকে কোলে লইয়া অনেক মত সান্ত্বনা করিয়া বলিলেন— “মা আমার লক্ষ্মী, তুমি তো বেশ বুঝ, কি, আমাদের পরমেশ্বর আছেন, কেঁদ না। আবার এই কয়দিন পরেই তোমাকে আনিব।” তখন আমার এত ভয় হইয়াছে যে, আমার শরীর থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। আমার এমন হইয়াছে যে, মুখে কথা বলিতে পারি না, তখন কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলাম, “মা! পরমেশ্বর কি আমার সঙ্গে যাবেন?”

শ্বশুরবাড়ী রামদিয়া গ্রাম তিনদিনের পথ, যেদিন সেই গ্রামে উপনীত হইবেন, সেদিন নৌকার সকলে বলিতে লাগিল— “আজ আমরা বাটী যাইব”। তখন আমার মনে একবার উদ হইল বুঝি আমাদের বাটীতেই যাইব। সেই রাত্রে নৌকা হইতে উঠিয়া দেখিলেন, এ বাড়ীসে বাড়ী নহে, তখন “হৃদয় বিদীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল। আমার এমন হইল যে চক্ষে শতধারায় জল পড়িতে লাগিল।”

এখন আর সকল স্থলে শ্বশুরবাড়ী-যাত্রিনীর এরূপ কান্নাকাটি নাইএ চিত্র প্রাচীনকালে খাঁটি চিত্র। প্রাচীন গান, প্রাচীন কাব্য এই করুণ কাহিনীতে পরিপুত। এই চিত্র দেখিতে দেখিতে— “বল দেখি মা, উমা কেমন ছিলি মা, ভিখারী হরের (ই) ঘরে,” কিম্বা “উমা এল বলি রাণী এলোকেশে ধায়,” “গিরি আমার গৌরী এসেছিল, স্বপ্পে দেখা দিয়ে, চৈতন্য রিয়ে, চৈতন্যরূপিণী কোথায় লুকাইল,” প্রভৃতি নয়নাসারসিঞ্চিত প্রাচীন গানগুলি মনে পড়িয়াছেকন্যাবিরহে জননীর আকুল অশ্রসিক্ত মুখখানি ও বেদনাপূর্ণ হৃদয়ের আগ্রহ তখন ভাল করিয়া বুঝিতে পারিয়াছি। দুধের বালিকাএকান্ত অবোধ, তাহার বাধা দিবার শক্তি নাই, আঘাত দিলে হৃদয় ভাঙিয়া যায়এইরূপ শিশু কন্যাকে অপরের গৃহে পাঠাইবার সময় সমস্ত পল্লীখানি মৌনবেদনায় কম্পিত হইয়া উঠিত। এই চিত্র এখন স্মৃতিমাত্রে পর্যবসিত হইতে চলিয়াছে। এই স্মৃতিটুকু আমরা বড় ভালোবাসি।

শ্বশুরবাড়ি যাইতে বালিকার সজল চক্ষু দুটি আত্মীয়গণের কথা সন্ধান করিত, “পক্ষীটা, কি গাছটা, কি বিড়ালটা, যা দেখিতাম তাহাতে আমার জ্ঞান হইত যে আমার বাপের বাড়ীর দেশ হইতে আসিয়াছে, এই ভাবিয়া কাঁদিতাম।” এই দুঃখের সময় “আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী আমাকে কোলে লইয়া সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন।”

“তাঁহার সেই কোল যেন আমার মায়ের কোলের মত বোধ হইতে লাগিল। তিনি যেরূপ স্নেহের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন, তাহাতে আমার বোধ হইতে লাগিল যেন তিনি আমার মা। অথচ তিনি আমার মায়ের আকৃতি নহেন। আমার মা বড় সুন্দরী ছিলেন। আমার শাশুড়ী ঠাকুরাণী শ্যামবর্ণা এবং আমার মায়ের সহিত অন্য কোন সাদৃশ্য নাই। তথাপি তিনি কোলে লইলে আমি মা জ্ঞান করিয়া চক্ষু বুজিতাম।”

রাসসুন্দরী এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া বলিয়াছেন, “এ কি অপূর্ব ঘটনা। কোন্‌ গাছের বাকল কোন্‌ গাছে লাগিল। তাহাদের কাছে সকল দিন থাকিতে থাকিতে আমি তাহাদের পোষা হইয়া তাহাদের শরণাগত হইলাম—।”

রাসসুন্দরী বড় আদুরে মেয়ে ছিলেন, পিতৃগৃহে তাঁহাকে কেহ কাজ করিতে দিতেন না, কিন্তু এক জ্ঞাতি খুড়ী অত্যন্ত পীড়িতা ছিলেন, বালিকা লুকাইয়া তাঁহার বাড়ীতে যাইয়া তাঁহার সমস্ত কাজ এমনকি রন্ধনাদিও করাইয়া দিত। এইভাবে তিনি কাজ শিখিয়াছিলেন। একদিন সেই খুড়ীর বাড়ীতে তাঁহার মাথায় তৈল মাখাইয়া দিতেছিল, সেই সময় তাঁহার পিসীমা আসাতে সে ভয়ে লুকাইয়া রহিল। সে লুকাইয়া রহিয়াছে কেন অনুসন্ধান করিয়া পিসীমা জানিলেনসে কাজ করিতেছিলতাহাকে কাজ করিতে দেখিলে যদি তিনি কিছু বলেন, এই ভয়ে সে পলাইয়াছে। পিসীমা এই সংবাদ মায়ের নিকট লইয়া আসিলেন, মাতা আহ্লাদে তাহাকে কোলে লইয়া বলিলেন,“মা কাজ কোথায় শিখিয়াছ, কাজ করিয়া দেখাও দেখি।”

কিন্তু আমোদে আহ্লাদে যাহা শিখিয়াছিলেন, বিপুল কর্তব্য সম্পাদনের জন্য অচিরে তাহার প্রয়োজন হইল। বিবাহের পর যৌবনের প্রারম্ভে শ্বশুরবাড়ীর বৃহৎ সংসারের ভার রাসসুন্দরীর উপর পড়িল। “এই সংসারটি বড় কম নহে, দস্তরমতই আছেবাটীতে বিগ্রহ স্থাপিত আছেন— তাঁহার সেবাতে অন্ন ব্যঞ্জন ভোগ হয়। বাটীতে অতিথি পথিক সতত আসিয়া থাকে। এদিকে রান্না বড় কম নহে। আমার দেবর, ভাসুর কেহ ছিলেন না বটে, কিন্তু চাকর-চাকরাণী ২৫-২৬ জন বাটীর মধ্যে ভাত খাইত, তাহাদিগকে পাক করিয়া দিতে হইত। বিশেষতঃ ঠাকুরাণী চক্ষুহীন হইয়াছেন, তাঁহার সেবাও সর্বোপরি।” তখনকার ছেলেমেয়েদের এই প্রকার নিয়ম ছিলযে বৌ হইবে, সে হাতখানেক ঘোমটা দিয়ে ঘরের মধ্যে কাজ করিবে, কাহারও সঙ্গে কথা কহিবে না। সেকালে এখনকার মত চিকন কাপড় ছিল না, মোটা কাপড় ছিল। “আমি সেই কাপড় পরিয়া বুক পর্যন্ত ঘোমটা দিয়া এ সকল কাজ করিতাম, আর যে সকল লোক ছিল, কাহার সঙ্গে কথা কহিতাম না। আপনার পায়ের পাতা ভিন্ন অন্য কোন দিকে দৃষ্টি চলিত না।”

এই সমস্ত কঠোর সামাজিক আচার রাসসুন্দরী প্রীতির চক্ষেই দেখিয়াছেন। ইহা তাঁহাকে সম্পূর্ণরূপে মানাইয়া গিয়াছিল, তাই অশোভন হয় নাই। এ সম্বন্ধে তিনি লিখিয়াছেন“বস্ততঃ পরমেশ্বর যখন যেরূপ আচার ব্যবহার নির্দেশ করিতেছেন, তখন তাহা উত্তম বলিয়া বোধ হয়। সেই কালের লোকের সেই মোটা মোটা কাপড়, ভারি ভারি গহনা, হাতপোরা শাখাকপালরা সিন্দূর, বড় বেশ দেখাইত।”
সাংসারিক অসামান্য শ্রমের পরে, অনেক দিন রাসসুন্দরীর খাওয়া হইত না, হয়ত অপরাহ্নকালে সকলকে খাওয়াইয়া নিজে খাইতে বসিবেন, এমন সময় অতিথি আসিয়া উপস্থিত হইল, তখন মুখের গ্রাস তাহাকে দিয়া নিজে উপবাসী রহিলেন। একদিনকার ইতিহাস তিনি দিয়াছেন। মুখের গ্রাস এক নমঃশূদ্র অতিথিকে দিয়া আর সেদিন খাওয়া হইল না। এরূপ ঘটনা ঘটিতে লাগিল যে ক্রমাদুইদিন তিনি কিছু খাইতে অবকাশ বা সুবিধা পাইলেন না— অথচ বাড়ীর কেহ তাহা জানিতে পারিল না। সেই ইতিহাস পড়িতে গেলে পাঠক অশ্রু সংবরণ করিতে পারিবেন নাঅথচ এইরূপ মাঝে মাঝে তাঁহাকে প্রায়ই উপবাসী থাকিয়া সমস্ত দিন খাটিতে হইত। “আমি ঘরের মধ্যে একা, আর অন্য কোন লোক নাইঘরে খাবার নানাদ্রব্য আছে। আমি খেলেও খেতে পারি, কে বারণ করে? বরং আমাকে খাইতে দেখিলে ঘরে লোকেরা সন্তষ্ট হইবে, কিন্ত আমি ভাত ছাড়া অন্য জিনিষ আপনি লইয়া খাইতাম না।” এই অন্নপূর্ণামূর্ত্তি হিন্দুস্থানের নিজস্ব। জগতে কোথাও ইহার তুলনা নাই। এই ত্যাগশীলা করুণাময়ী মূর্ত্তি দি আধুনিক বিলাসকলায় মলিন হইয়া থাকে, তাহা হইতে দুর্দশা আমাদের আর কিছুই নাই।
গৃহের কাজ ছাড়া সেকালের রমণীগণ একটু শিল্পচর্চা করিতেন। তাহা বিলাসের সামগ্রী লইয়া নহে, প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির উপর প্রীতির হস্ত নিপুণভাবে শোভাদান করিত, তাহাতে বাঙ্গালীর কুটিখানি উজ্জ্বহইয়া উঠিত। “সে সময় কেবল কড়ি ছিল, কড়িতেই সকল কারবার চলিত, আমি কড়ি আনিয়া নানাবিধ জিনিষ তৈরী করিতে আরম্ভ করিলাম। ঝাড়, পদ্ম, আরশি, ছত্র, আলনা, শিকা, এই সকল বানাইয়া ঘরে লটকাইয়া রাখিতাম। আর পাথর কাটিয়া ক্ষীরের ছাঁচ বানাইবার জন্য ঞ্চ বানাইতাম। মাটি দিয়া পুতুল, ঠাকুর, সাপ, বাঘ, মানুষ, গরু, পক্ষী ইত্যাদি যা দেখিতাম তাহাই বানাইতাম।”
মোটকথা রাসসুন্দরীর এই জীবন কথা আমরা শুধু ব্যক্তিগত কাহিনী বলিয়া তুচ্ছ করিতে পারি না। সমস্ত প্রাচীন সমাজ চিত্রখানি যেঁতাঁহাকে উপলক্ষ মাত্র করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে।
রাসসুন্দরী এক বিষয়ে তাঁহার সময়ের আচার ব্যবহারের বিরোধী ছিলেন। তিনি লেখাপড়া শিখিবার জন্য যে যত্ন করিয়াছিলেন, তাহা পাঠ করিলে তদুদ্দেশ্যে ডুবালাদির যত্ন অতি সামান্য বলিয়া বোধ হইবে। কেহ দেখিবে এই ভয়ে তিনি লোকমক্ষে কোন পুস্তকের দিকে দৃষ্টি করিতেও ভীত হইতেন, অথচ গোপনে অসাধারণ চেষ্টায় অক্ষরপরিচয় সমাধা করেন। কিন্ত লুকাইয়া পাঠ করিতে শেখা বরং সহজএকখানি পুস্তকের পাতা অঞ্চলে লুকাইয়া বরং নির্জনে পড়া চলে; কিন্তু “লিখিতে বসিলে তাহার অনেক আয়োজন লাগে, কাগজ, কলম, কালি দোয়াত চাহি। তাহ! লইয়া ঘটা করিয়া সাজাইয়া বসিতে হয়।” এইরূপ ভাবে ধরা পড়িবার আশঙ্কা খুব বেশী । রাসসুন্দরী প্রৌঢ় বয়সে যে উৎকট যত্নে লিখিতে পড়িতে শিখিয়াছিলেন, তাহার প্রশংসা করিয়া শেষ করা যায় না। অপত্যস্নেহে মাতার চিত্তে আধাত্ম্য শক্তি (Physical Power) বিকাশ করিয়া দেয়, এ সম্বন্ধে রাসসুন্দরী যে দুই তিনটি দৃষ্টান্ত লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাহা তত্ত্ববিদ্যার সভায় আদর লাভ করিবে। আমরাও তাহা কিছুমাত্র অসম্ভব নে করি না। তাহার এক প্রবাসী-পুত্রের মৃত্যুর বিষয় যে স্বপ্ন দেখিয়াছিলেন, প্রকৃত মৃত্যু ঘটনা তারিখাদি সকল বিষয়ে ঠিক তেমনি হইয়াছিল।
সঙ্গীহীন অন্তঃপুরের নির্জতায় ও নিঃস্বার্থ সেবাধর্ম এবং শতপ্রকার কষ্টে আত্মানুসন্ধান ও ঈশ্বরের প্রতি ভক্তির বিকাসহ হওয়া স্বাভাবিকরাসসুন্দরীর পুস্তক আদ্যন্ত ধর্মের কথায় পূর্ণ। শেষাংশে এই ধর্মতত্ত্ব একটু বেশী নিবিড় হইয়া ইতিহাসের দিকটা খর্ব করিয়া ফেলিয়াছে শেষাংশটি প্রথমাংশের
ন্যায় কৌতূহলোদ্দীপক ও হৃদয়গ্রাহী হয় নাই। তাহার রাশি রাশি ভগবৎ স্তোত্র তাহার ভক্তির পরিচায়ক— কিন্তু তাদৃশ কবিত্বশক্তির পরিচায়ক বলিয়া গণ্য হইবে না। তাহার গ্রন্থভাগের ভাষা সহজ, স্বচ্ছন্দরলরূপ খাঁটি বাঙ্গালা আমাদের সাহিত্যে অতি অল্পই আছে। এই বাঙ্গালা এত হজ ও মর্মস্পর্শী যে আধুনিক বাক্যপল্লবপূর্ণ অনেক রচনা এই খাটিভাষা পাঠের পর বিরক্তিকর বোধ হইবে।
পুস্তক
খানিতে প্রাচীন পুরনারীগণের যে চিত্রটি আছে, তাহা আমাদের বর্তমান সময়ের মহিলাগণ একবাযত্নের সহিত দেখিবেন এই অনুরোধ। আমরা কুন্দনন্দিনীর প্রতি অতি প্রশংসা প্রদান করিয়া যেন গৃহের অন্নপূর্ণার প্রতি বীতশ্রদ্ধ না হইইহাই কামনা । পরিবর্তন র্থেই উন্নতি নহেবেশবিন্যাস বাহ্য চাকচিক্য মাত্র—  প্রাচীনকালের দোষগুণ লইয়া হিন্দুরমণীগণ যে মূর্ত্তিতে গৃহখানিকে স্নেহ ও ত্যাগের মহিমায় পূর্ণ করিয়া রাখিতেন— সেই পবিত্র প্রভাবিরহিত হইলে হিন্দুর গৃহস্থলীর প্রকৃত শোভা চলিয়া যাইবে। বাহিরে আমরা অপমানিত, হৃতসর্বস্ব, লাঞ্ছিত ও পরমুখাপেক্ষীগৃহ ভিন্ন আমাদের দাঁড়াইবার স্থান কোথায়? বাঙ্গালীর গৃহের গৃহিণীগণ কিরূপ ছিলেন, তাহার দৃষ্টান্তস্বরূপ এই চিত্রখানি আমরা বিশ্বের দ্বারে গৌরবে উন্মোচন করিয়া দেখাইতে পারি।

দীনেশচন্দ্র সেন

(ক্রমশ ...) 
[এরপরে মূল গ্রন্থ দেওয়া হবে।]

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ