বৈষ্ণব পদাবলীতে কবি বিদ্যাপতির কবিকৃতি পর্যালোচনা
ড. পরিতোষ মাহাত
মধ্যযুগের
বাংলা সাহিত্যে প্রধানত গীতিকবিতার মধ্য দিয়ে যে অধ্যাত্মচেতনার অপরূপ বিকাশ ঘটেছে
তা বৈষ্ণব পদাবলী। ভক্তিপ্রাণ চিত্তের ঈশ্বরভাবনার পরম আনন্দময় প্রকাশ ঘটেছে
বৈষ্ণব পদাবলীতে। আর এই বৈষ্ণব পদাবলীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে বিদ্যাপতি
বাঙালির হৃদয় সিংহাসনে চিরকালের প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
বিদ্যাপতি
বাঙালি কবি নন। মিথিলার রাজসভার কবি ছিলেন। তাঁর জন্ম হয় চতুর্দশ শতাব্দীর শেষভাগে
আনুমানিক ১৩৯৮ খ্রিস্টাব্দে দ্বারভাঙ্গার মধুবনি মহকুমার অন্তর্গত বিসফী গ্রামে।
তিনি পঞ্চদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে প্রয়াত হন। তাঁর পিতার নাম গণপতি ঠাকুর। বিদ্যাপতি
মিথিলার রাজা শিবসিংহ ও কীর্তিসিংহের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেছিলেন। বিদ্যাপতি অসাধারণ
পাণ্ডিত্য ও প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। তিনি স্মৃতি, ইতিহাস, ভূগোল, জ্যোতিষ,
সামাজিকতা নিয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন। সংস্কৃতে রচিত গ্রন্থের মধ্যে বিশিষ্ট হল
‘পুরুষপরীক্ষা’, ‘কীর্তিপতাকা’, ‘শৈবসর্বস্বহার’, ‘গঙ্গাবাক্যবলী’, ‘বিভাগসার’,
‘দানবাক্যাবলী’, ‘দুর্গাভক্তিতরঙ্গিণী’ ইত্যাদি। তবে ব্রজবুলি ভাষায় রচিত
রাধাকৃষ্ণ পদাবলী রচনার জন্য তিনি বৈষ্ণব পদাবলী সাহিত্যে ‘মৈথিল কোকিল’ ও ‘অভিনব
জয়দেব’ অভিধায় অমর কবিখ্যাতির আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত।
বিদ্যাপতি ছিলেন রাজসভার কবি। তাই রাজকীয়
বিলাস ও ঐশ্বর্যমণ্ডনে তাঁর কবিতা উজ্জ্বল ঋদ্ধ। তিনি প্রণয়ের রূপকার-শিল্পী। তাঁর
প্রেমের কবিতায় কবি মানব-মানবীর চিরন্তন জীবনছন্দ ও ভালবাসার গভীর অনুভবকে রূপ
দিয়েছেন। বিদ্যাপতি রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার বিভিন্ন পর্যায় অবলম্বন করেই পদ রচনা
করেছেন। বিদ্যাপতির সৌন্দর্য-রসজ্ঞতার প্রথম পরিচয় পাওয়া যায় বয়ঃসন্ধির পদে।
যৌবনের উন্মেষে যেমন কিশোর দেহে পরিবর্তন দেখা যায়, তেমনই পরিবর্তন সূচিত হয় মনেও।
এ সময় একদিকে উল্লাস, অন্যদিকে বেদনা, হাসিকান্নার যুগপৎ উপস্থিতি। শ্রীরাধিকার
দেহ-মনের এই দ্বন্দ্ব বিদ্যাপতি চমৎকার ফুটিয়েছেন। যথা –
“কবহু
বাঁধয় কুচ কবহু বিথারি।
কবহু
ঝাঁপয় অঙ্গ কবহু উঘারি।।”
বিদ্যাপতি পূর্বরাগের পদে রাধাকে
সৌন্দর্যলক্ষ্মী রাজেন্দ্রাণী রূপে তুলে ধরেছেন। বয়ঃসন্ধির রূপতন্ময়তা এখানে
ভাবতন্ময়তায় এসে গেছে। যেমন, শ্রীকৃষ্ণের রূপদর্শনে বিভোর রাধা বলেছে, -
“এ সখি
কি দেখল এক অপরূপ।
শুনইতে
মানবি স্বপন স্বরূপ।।
কমল
যুগল পর চাঁদক মাল।
তাপর
উপজল তরুণ তমাল।।”
অভিসারের পদে বিদ্যাপতির কবিপ্রতিভার
চমৎকার আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। অভিসারের লৌকিক আবেদনের মধ্যে অলৌকিকতার সুর অনুভব করা
যায়। দেহের মধ্যে দেহাতীতের, রূপের মধ্যে অপরূপের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন। যেমন –
“বরিষ
পয়োধর ধরণী বারিভর
রজনী মহাভয় ভীমা।
তুইও
চলতি ধনি তুয় গুণ মনে শুনি
তবু সাহস নাহি সীমা।।”
মিলনের পদে
প্রবৃত্তির দাবদাহে চেতনার সঙ্কট না দেখিয়ে তার মধ্যেও প্রেমের নিত্যতার সন্ধান
করেছেন। মিলনেও প্রেম সঙ্কীর্ণ স্পৃহার ঘেরাটোপে আবদ্ধ থাকে না, তা হয়ে ওঠে অনন্ত
আনন্দময়। ক্ষণিকের ক্ষুদ্রতায় বা কামনার সঙ্কীর্ণতায় এই প্রেম নিঃশেষিত হয় না।
যেমন –
“সখি কি পুছসি অনুভব মোয়।
সেই
পিরীতি অনু- রাগ বাখানিতে
তিলে তিলে নতুন হোয়।।”
মাথুর বা বিরহের পদে বিদ্যাপতি
‘রাজাধিরাজ’। তাঁর কবিত্বশক্তি বিরহের পদে শ্রেষ্ঠ সীমায় এসে পৌঁছেছে। প্রেমের
মহিমা দুঃখের বোধেই পূর্ণ হয়ে ওঠে। বিরহবেদনা প্রেমকে ক্ষুদ্রতার ঊর্ধ্বে এক
অনন্তলোকে স্থাপন করে। দুঃখের যজ্ঞ অনল জ্বলনে জন্মে যে প্রেম, দীপ্ত যে প্রেম,
নিত্য যে নিঃসংশয়, গৌরব তার অক্ষয়। বিদ্যাপতির বিরহের কবিতায় রাধার হৃদয়ের ব্যাকুল
ক্রন্দন ভালবাসায় উৎসারিত হয়েছে। কান্নার মধ্যেই চিরকালের মানবহৃদয় অনুরাগে নিবিড়
নিমগ্ন হয়েছে। তাঁর এই পর্যায়ের পদে বিরহী হৃদয়ের গভীরতম বেদনার বাণী ভাষারূপ পেয়েছে।
যেমন –
“এ সখি
হামারি দুঃখের নাহি ওর।
এ ভরা
বাদর মাহ ভাদর
শূন্য মন্দির মোর।।”
এই বিরহ সমগ্র জাগতিক পরিবেশের মধ্যে সঞ্চার করে অসহনীয়
শূন্যতা। -
“শূন
ভেল মন্দির শূন ভেল নগরী।
শূন ভেল
দশদিশ শূন ভেল সগরী।।”
প্রার্থনা সাধনারই অঙ্গ। বাঞ্ছিত বস্তু
লাভের জন্য প্রয়াসই সাধনা। বৈষ্ণবের প্রার্থিত বিষয় ঈশ্বরলাভ। প্রার্থনার পদে বিদ্যাপতি
সেই পরমের প্রতি কামনা আন্তরিকভাবে ব্যক্ত করেছেন। এই পর্যায়ে কবির ঈশ্বর
ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে যাতে আছে ধূসর মলিন উত্তাল জীবনচর্যার অতিক্রান্তে ত্যাগ
বৈরাগ্য ও শান্তির বাণী। ক্ষুদ্রতার অবসানে বৃহতের সঙ্গে মিলনের পরম বাসনা। যেমন –
“মাধব বহুত মিনতি করি তোয়।
দেই
তুলসী তিল এ দেহ সমর্পিলুঁ
দয়া জনু ছোড়বি মোয়।।”
বিদ্যাপতির প্রার্থনা পর্যায়ে কবির
আত্মদৈন্য, আত্মনিবেদন ও ঈশ্বরভক্তির যে পরিচয় পাওয়া যায়, তা সাধক কবির ভাবুক
রূপটিকে পরিস্ফুট করেছে। সমালোচকদের মতে, প্রার্থনার পদে বিদ্যাপতিই শ্রেষ্ঠ
রূপকার।
বিদ্যাপতির
কাব্য শিল্পচাতুর্যের বিস্ময়কর পরিচয়বহ। রূপের দীপ্তি, সৌন্দর্যের হিল্লোল,
ছন্দজ্ঞান, অলঙ্কার প্রয়োগের নৈপুণ্য, শব্দযোজনার দক্ষতায় তিনি নির্মাণ করেছেন
অপরূপ কাব্যপ্রতিমা। তাঁর কাব্যে মাধুর্যের অন্তহীন নিঃসরণ সঞ্চার করেছে কমনীয়
কান্তি। তিনি অসামান্য রূপস্রষ্টা। চিরদিন রূপের পূজারী তিনি। রূপনির্মাণদক্ষ কবি বিদ্যাপতি
তাই বাংলা সাহিত্যের সৃজনক্ষেত্রে বর্ণবৈচিত্র্যের সুষমাময় রূপশিল্পী, সার্থক
রূপকার।
চিত্র সৌজন্যে-উইকিপিডিয়া
0 মন্তব্যসমূহ