Header Ads Widget

WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা ** WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা **

ticker

6/recent/ticker-posts

মানুষের মন - বনফুল - বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প

 মানুষের মন - বনফুল - বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প 

মানুষের মন মানুষের মন - বনফুল - বনফুলের শ্রেষ্ঠ গল্প 


মানুষের মন

বনফুল

রেশ ও পরেশ। দুইজনে সহোদর ভাই। কিন্তু এক বৃন্তে দুইটি ফুলএ উপমা ইহাদের সম্বন্ধে খাটে না আকৃতি ও প্রকৃতি—  উভয় দিক দিয়াই ইহাদের মিলের অপেক্ষা অমিলই বেশি। নরেশের চোহারার মোটামুটি বর্ণনাটা এইরূপ শ্যাম বর্ণ, দীর্ঘ দেহ, খোচা-খোঁচা চিরুনি-সম্পর্ক-বিরহিত চুল, গোলাকার মুখ এবং সেই মুখে একজোড়া বুদ্ধিদীপ্ত চক্ষু একজোড়া নেউলের লেজের মতো পুষ্ট গোঁফ এবং একটি সুক্ষ্মাগ্র শুষ্কচঞ্চু নাসা।

পরেশ খর্বাকৃতি, ফরসা, মাথার কোঁকড়ানো কেশদাম বাবরি আকারে সুসজ্জিত, মুখটি একটু লম্বা-গোছের, নাকটি থ্যাবড়া, চক্ষু দুইটিতে কেমন যেন একটা তন্ময় ভাব, গোঁফদাড়ি কামানো, গলায় কণ্ঠি, কপালে চন্দন।

মনের দিক দিয়া বিচার করিলে দেখা যায় যে দুইজনেই গোঁড়া। একজন গোঁড়া বৈজ্ঞানিক এবং আর একজন গোঁড়া বৈষ্ণব। অত্যন্ত নিষ্ঠাসহকারে নরেশ জ্ঞানমার্গ এবং পরেশ ভক্তিমার্গ অবলম্বন করিয়াছেন।

যখন নরেশের ‘কমবাইন্ড হ্যান্ড’ চাকর নরেশের জন্য ফাউল কাটলেট বানাইতে ব্যস্ত এবং নরেশ থিওরি অফ রিলেটিভিটি লইয়া উন্মত্ত তখন সেই একই বাড়িতে পরেশ স্বপাক নিরামিষ আহার করিয়া যোগবাশিষ্ট রামায়ণে মগ্ন ইহা প্রায়ই দেখা যাইত।

তাই বলিয়া ভাবিবেন না যে, উভয়ে সর্বদা লাঠালাঠি করিতেন, মোটেই তা নয়। ইহাদের কলহ মোটেই নাই। তাহার সুস্পষ্ট কারণ বোধহয় এই যে, অর্থের দিক দিয়া কেহ কাহারও মুখাপেক্ষী নন।

       উভয়েই এম. এ. পাসনরেশ কেমিস্ট্রিতে এবং পরেশ সংস্কৃতে। উভয়েই কলেজের প্রোফেসারি করিয়া মোটা বেতন পান। মরবার পূর্বে পিতা দুইজনকেই সমান ভাগে নগদ টাকাও কিছু দিয়া গিয়াছিলেন। যে বাড়িতে ইহারা বাস করিতেছেনইহাও পৈতৃক সম্পত্তি। বাড়িটি বেশ বড়। এত বড় যে ইহাতে দুই-তিনটি পরিবার পুত্র-পৌত্রাদি লইয়া বেশ স্বচ্ছন্দে বাস করিতে পারে। কিন্তু নরেশ এবং পরেশ দুইজনেই পরিবারহীন। নরেশ বিবাহ করিয়াছিলেন। কিন্তু বিবাহের কিছুদিন পরেই পত্নী ইহলোক ত্যাগ করাতে তাহার এবং পরেশের মনে পৃথিবীর অনিত্যতা সম্বন্ধে এমন একটা উপলব্ধি আসিল যে, কেহই আর বিবাহ করিলেন না। পরেশ ভাবিলেন, ‘কা তব কান্তা’— ইহাই সত্য। রিলেটিভিটির ছাত্র নরেশ ভাবিতে লাগিলেন, নির্মলা সত্যই কি মরিয়াছে? আমি দেখিতে পাইতেছি নাএই মাত্র।

সুতরাং নরেশ এবং পরেশ সহোদর হওয়া সত্ত্বেও ভিন্ন প্রকৃতির এবং ভিন্ন প্রকৃতির হওয়া সত্তেও একই বাড়িতে বাস করেন।

এক বিষয়ে কিন্তু উভয়ের মিলও ছিল।

পল্টুকে উভয়ে ভালোবাসিতেন। পল্টু তপেশের পুত্র। নরেশ এবং পরেশের ছোট ভাই তপেশ। এলাহাবাদে চাকুরি করিত। হঠাৎ একদিন কলেরা হইয়া তপেশ এবং তপেশের পত্নী মনোরমা মারা গেল। টেলিগ্রামে আহূত নরেশ এবং পরেশ গিয়া তাহাদের শেষ কথাগুলি মাত্র শুনিবার অবসর পাইলেন। তাহার মর্ম এই— “আমরা চললাম। পল্টুকে তোমরা দেখো।” পল্টুকে লইয়া নরেশ এবং পরেশ কলিকাতায় ফিরিয়া আসিলেন। তপেশের অংশে পৈত্রিক কিছু টাকা ছিল। নরেশ তাহার অর্ধাংশ পরেশের সন্তোষার্থে রামকৃষ্ণ মিশনে দিবার প্রস্তাব করিবামাত্রই পরেশ বলিলেন,—  বাকি অর্ধেকটা তা হলে বিজ্ঞানের উন্নতিকল্পে খরচ হোক।” তাহাই হইল। পল্টুর ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে তাহারা ভাবিলেন যে, তাহারা নিজেরা যখন কেহই সংসারী নহেন তখন পল্টুর আর ভাবনা কি?

পল্টু, নরেশ এবং পরেশ উভয়েরই নয়নের মণিরূপে বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। নরেশ এবং পরেশ কেহই নিজের মতবাদ পল্টুর উপর ফলাইতে যাইতেন না। পল্টুর যখন যাহা অভিরুচি সে তাহাই করিত। নরেশের সঙ্গে আহার করিতে করিতে যখন তাহার মুরগি সম্বন্ধে মোহ কাটিয়া আসিত, তখন সে পরেশের হবিষ্যান্নের দিকে কিছুদিন ঝুঁকিত। ভোজনশালায় ফিরিয়া যাইতেও তাহার বাধিত না।

নরেশ এবং পরেশ উভয়েই তাহাকে কোনও নির্দিষ্ট বাঁধনে বাঁধিতে চাহিতেন নাযদিও দুইজনেই মনে মনে আশা করিতেন যে, বড় হইয়া পল্টু তাহার আদর্শকেই বরণ করিবে।

পল্টুর বয়স ষোল বৎসর। এইবার ম্যাট্রিক দিবে। সুন্দর স্বাস্থ্য, ধপধপে ফরসা গায়ের রঙ, আয়ত চক্ষু। নরেশ এবং পরেশ দুইজনেই সর্বস্তঃকরণে পল্টুকে ভালোবাসিতেন। এ বিষয়ে উভয়ের কিছুমাত্র অমিল ছিল না।

এই পল্টু একদিন অসুখে পড়িল।

নরেশ এবং পরেশ চিন্তিত হইলেন। নরেশ বৈজ্ঞানিক মানুষ, তিনি স্বভাবতঃই একজন অ্যালোপ্যাথিক ডাক্তার লইয়া আসিলেন। পরেশ প্রথমটায় কিছু আপত্তি করেন নাই; কিন্তু যখন উপর্যুপরি সাত দিন কাটিয়া গেল, জ্বর ছাড়িল না তখন তিনি আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। নরেশকে বলিলেন— “আমার মনে হয় একজন ভালো কবিরাজ ডেকে দেখালে কেমন হত?”

বেশ, দেখাও।”

কবিরাজ আসিলেন, সাত দিন চিকিৎসা করিলেন। জ্বর কমিল না, বরং বাড়িল। পল্টু প্রলাপ বকিতে লাগিল। অস্থির পরেশ তখন নরেশকে বলিলেন, “আচ্ছা, একজন জ্যোতিষীকে ডেকে ওর কুষ্ঠিটা দেখালে কেমন হয়? কি বল?”

বেশ তো! তবে যাই কর, এ জ্বর একুশ দিনের আগে কমবে না। ডাক্তারবাবু বলেছিলেন টাইফয়েড।”

তাই নাকি?”

পল্টুর কোষ্ঠি লইয়া ব্যাকুল পরেশ জ্যোতিষীর বাড়ি ছুটিলেন। জ্যোতিষী কহিলেন-_“মঙ্গল মারকেশ। তিনি রুষ্ট, হইয়াছেন।” কি করিলে তিনি শান্ত হইবেন, তাহার একটা ফর্দ দিলেন। পরেশ প্রবাল কিনিয়া পল্টুর হাতে বাঁধিয়া মঙ্গলের শান্তির জন্য শাস্ত্রীয় ব্যবস্থাদি করিতে লাগিলেন।

অসুখ কিন্তু উপরোত্তর বাড়িয়াই চলিয়াছে। নরেশ একদিন বলিলেন— “কবিরাজি ওষুধেতে বিশেষ উপকার হচ্ছে না, ডাক্তারকেই আবার ডাকব নাকি?”

তাই ডাক না হয়!”

নরেশ ডাক্তার ডাকিতে গেলেন। পরেশ পল্টুর মাথার শিয়রে বসিয়া মাথায় জলপটি দিতে লাগিলেন। পল্টু প্রলাপ বকিতেছে— “মা আমাকে নিয়ে যাও। বাবা কোথায়?”

আতঙ্কে পরেশের বুকটা কাঁপিয়া উঠিল। হঠাৎ তাহার মনে হইল, তারকেশ্বরে গিয়া ধরণা দিলে শুনিয়াছি দৈব ষধ পাওয়া যায়। ঠিক।

নরেশ ফিরিয়া আসিতেই পরেশ বলিলেন— “আমি একবার তারকেশ্বর চললাম, ফিরতে দু-এক দিন দেরি হবে।”

হঠাৎ তারকেশ্বর কেন?”

বাবার কাছে ধরনা দেব।”

নরেশ কিছু বলিলেন না। ব্যস্তসমস্ত পরেশ বাহির হইয়া গেলেন। ডাক্তার পরীক্ষা করিয়া বলিলেন— “বড় খারাপ টার্ন নিয়েছে।”

ডাক্তারি চিকিৎসা চলিতে লাগিল।

দিন দুই পরে পরেশ ফিরিলেন। হস্তে একটি মাটির ভাঁড়। উল্লসিত হইয়া তিনি বলিলেন— “বাবার স্বপ্নাদেশ পেলাম। তিনি বললেন যে, রোগীকে যেন ইঞ্জেকশন দেওয়া না হয়। আর বললেন, এই চরণামৃত রোজ একবার করে খাইয়ে দিতে, তা হলেই সেরে যাবে।”

ডাক্তারবাবু আপত্তি করিলেন। নরেশও আপত্তি করিলেন। টাইফয়েড রোগীকে ফুল-বেলপাতা-পচা জল কিছুতেই খাওয়ানো চলিতে পারে না।

 হতবুদ্ধি পরেশ ভান্ডহস্তে চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিলেন।

আসলে কিন্তু ব্যাপার দাঁড়াইল অন্যরূপ। পরেশের আগোচের পল্টুকে ডাক্তারবাবু থাবিধি ইঞ্জেন দিতে লাগিলেন এবং ইহাদের আগোচরে পরেশ লুকাইয়া পল্টুকে প্রত্যহ একটু চরণামৃত পান করাইতে লাগিলেন।

কয়েকদিন চলিল। রোগের কিন্তু উপশম নাই।

গভীর রাত্রিতে হঠাৎ নরেশ পাশের ঘরে গিয়া পরেশকে জাগাইলেন।

ডাক্তারবাবুকে একবার খবর দেওয়া দরকার, পল্টু কেমন যেন করছে!”

আ্যা, বল কি?”

পল্টুর তখন শ্বাস উঠিয়াছে।

উন্মাদের মতো পরেশ ছুটিয়া নীচে নামিয়া গেলেন ডাক্তারকে “ফোন” করিতে। তাহার গলার স্বর শোনা যাইতে লাগিল

হ্যালোশুনছেন ডাক্তারবাবু, হ্যালোহাঁ, হাঁ, আমার আর ইঞ্জেন দিতে আপত্তি নেইবুঝলেন— হ্যালোবুঝলেনআপত্তি নেইআপনি ইঞ্জেকশন নিয়ে শিগগির আসুনআমার আপত্তি নেই, বুঝলেন—”

এদিকে নরেশ পাগলের মতো চরণামৃতের ভাঁড়টা পড়িয়া চামচে করিয়া খানিকটা চরণামৃত লইয়া পল্টুকে সাধ্যসাধনা করিতেছেন— “পল্টু খাও, খাও তো বাবা—  একবার খেয়ে নাও একটু—”

তাহার হাত থরথর করিয়া কাঁপিতেছে, চরণামৃত কশ বাহিয়া পড়িয়া গেল।


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ