বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
রামেন্দ্রসুন্দর
ত্রিবেদী রচিত ‘চরিতকথা’ থেকে
(১৩১২ সালের ২৬শে চৈত্র ক্ল্যাসিক থিয়েটারে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে আহূত স্মৃতি-সভায় বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে নিবন্ধটি লেখক কর্তৃক পঠিত হয়।)
বারো বৎসর অতীত হইল, বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার
শ্যামাঙ্গনী জননীর অঙ্কদেশ শূন্য করিয়া চলিয়া গিয়াছেন;
কিন্তু এত দিন আমরা তাঁহার স্মৃতির সম্মানার্থ
কোনরূপ আয়োজন আবশ্যক বোধ করি নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের প্রাতি আমাদের কর্তব্য-বুদ্ধি যে এত দিন জাগে নাই, তাহা আমাদের অবস্থার পক্ষে স্বাভবিক। বারো বৎসর পরে
যদি সেই কর্তব্যবুদ্ধি জাগিয়৷ থাকে, সেই
প্রবুদ্ধিসাধনে আমাদের কৃতিত্ব বিচার্য বিষয়। বঙ্কিমচন্দ্র
স্বয়ং কোন্ তপোলোকে বা সত্যলোকে অবস্থিত হইয়াও মর্ত্যলোকে তাঁহার দুঃখিনী জননীকে আজও
ভুলতে পারেন নাই;— সেইখানেই বসিয়া
“তুমি বিদ্যা, তুমি ধর্ম, তুমি হৃদি,
তুমি মর্ম, তং হি প্রাণাঃ শরীরে”[১] বলিয়া কাতরকণ্ঠে গান গাহিতেছেন;— আর মানবের অশ্রুতিগোচর সেই সঙ্গীত সপ্তকোটি কণ্ঠে কলকল নিনাদ উত্থাপিত
করিয়া বঙ্গভূমিকে জাগ্রত করিয়াছে। আমাদের কর্তব্যবুদ্ধি আজ যদি জাগিয়া থাকে, স্বয়ং
বঙ্কিমচন্দ্রই আমাদিগকে জাগাইয়াছেন, আমাদের উহাতে কোন
কৃতিত্ব নাই।
বঙ্কিমচন্দ্রের স্মৃতির উপাসনার জন্য আজিকার সভ৷ আহূত হইয়াছে; এবং যাঁহারা এই উপাসনার আয়োজন করিয়াছেন এবং এই উপাসনাকর্মকে সন্তবতঃ সাংবৎসরিক অনুষ্ঠানে পরিণত করিতে ইচ্ছা করেন, তাহারা, কি কারণে জানি না,
আজিকার অনুষ্ঠানের প্রধান ভার আমার উপর অর্পণ করিয়াছেন আমার প্রতি
তাহাঁদিগের এই অহৈতুকী শ্রদ্ধার পরিচয় পাইয়া
ও বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি আমার ভক্তিপ্রকাশের অবসর লাভ করিয়া আমি যুগপৎ গর্ব ও আনন্দ অনুভব করিতেছি, কিন্তু যোগ্যতর পাত্রে এই ভার অর্পিত হইলে উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলীকে বঞ্চিত হইতে হইত না। কেবল যে সময়োচিত বিনয়প্রকাশের জন্য আমি এ কথা বলিতোছি, তাহা নহে;
বঙ্কিমচন্দ্র যে বিস্তীর্ণ বঙ্গীয়-সাহিত্যের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব গ্রহণ
করিয়া তাঁহার সহবর্তী ও পরবর্তী অনুচরগণের পথপ্রদর্শক হইয়া গিয়াছেন, আমিও সেই বঙগীয়-সাহিত্য-ক্ষেত্রের এক প্রান্তে এক সঙ্কীর্ণ পথ আশ্রয় করিয়া মন্দগতিতে ধীরে ধীরে পদক্ষেপে সাহসী হইয়াছি; ইহাই আমার জীবনের কাজ ও ইহাই আমার জীবিকা ।
কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র তাঁহার প্রতিভার অত্যুজ্জ্বল
আলোকবর্তিকা হস্তে করিয়া সাহিত্যক্ষেত্রের যে
যে অংশ প্রদীপ্ত করিয়াছিলেন, সেই সেই অংশে আমার “প্রবেশ নিষেধ”। আমি দূর হইতে সেই আলোর উজ্জ্বল দীপ্তিতে মুগ্ধ হইয়াছি মাত্র, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের ভাগ্যবান সহচরগণের ও অনুচরগণের পদাঙ্ক অনুসরণ করিতেও আমি অধিকারী নহি। আজিকার আয়োজনের অনুষ্ঠাতাদিগের অনুগ্রহজন্য অকপট
কৃতজ্ঞতাস্বীকারে আম বাধ্য আছি; কিন্তু আমি আশা করি যে, আপনারা তাহাদের পাত্রনির্বাচনে বিষয়বুদ্ধির প্রশংসা করিবেন না।
বাঙ্গালীর জীবনের উপর বঙ্কিমচন্দ্র কত দিকে কত উপায়ে প্রভূত্ব বিস্তার করিয়াছেন, তাহা আমরা জানি; কিন্তু বাঙ্গালার বাহিরে সম্ভবতঃ তিনি বাঙ্গালার সার্ ওয়াল্টার স্কট মাত্র।[২] ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্রের সহিত পরিচয় অতি অল্প বয়সেই ঘটিয়াছিল, সে বয়সে উপন্যাসগ্রন্থের সহিত আমার পারিচয় বড়-একটা স্পৃহণীয় বলিয়া বিবেচিত হয় নাই। আমার যখন আট বংসর বয়স, তখন বঙ্গদর্শনে ‘বিষবৃক্ষ' বাহির হইতোছিল এবং আমি বঙ্গদর্শনের কয়েক সংখ্যা হইতে বিষবৃক্ষের দুই-চারিটি পরিচ্ছেদ আত্মসাৎ কায়াছিলাম। সেই বয়সে বিষবৃক্ষের সাহিত্য-রসের কিরূপ আস্বাদ অনুভব করিয়াছলাম, তাহা ঠিক মনে নাই; তবে এ কথা বেশ মনে আছে যে, পাঠশালায় গিয়৷ তারিণীচরণ চট্টোপাধ্যায়-প্রণীত ভূগোল বিবরণের ভারতবর্ষের অধ্যায়ে গঞ্জাম গঞ্জাম, চত্বরপুর চত্বরপুর, মসলিপটম মসলিপটম, আর্কট আর্কট, মাদুরা মাদুরা, টিনিভেলি টিনিভেলি প্রভৃতি অপরূপ সুশ্রাব্য নামাবলী আবৃত্তির ত্রুটি ঘটিলে পণ্ডিত মহাশয়ের নিকট বেত্রাঘাত উপহার পাইয়া বাঙ্গালা সাহিত্যের প্রতি যে অনুরাগ দাঁড়াইয়াছিল, নগেন্দ্রনাথের নৌকাযাত্রা ও কুন্দনন্দিনীর স্বপ্নদর্শন নিতান্তই তাহার সমর্থন ও পোষণ করে নাই। আমার বেশ মনে আছে যে, ‘পদ্মপলাশলোচনে তুমি কে’[৩] এই পরিচ্ছেদের সহিতই আমার তাৎকালিক বিষবৃক্ষ-পাঠ সমাপ্ত হয় এবং ঐ পরিচ্ছেদের শীর্ষস্থিত সংক্ষিপ্ত প্রশ্নটি মনের মধ্যে বিস্ময় ও কৌতূহলের উদ্রেক করিয়া কিছু দিনের জন্য একটা অতৃপ্ত আকাঙ্ক্ষার সৃষ্টি করে। কিছু দিনের জন্য মাত্র, কেন না, পর-বৎসর আমি পাঠশালার পরীক্ষায় যে পুরস্কার পাইয়াছিলাম, বাড়ী ফিরিয়া দেখিলাম, তাহার রাঙা ফিতার বন্ধনের মধ্যে শ্রীবঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-প্রণীত দুর্গেশনন্দিনী ও বিষবৃক্ষ নামক দুইখানি পুস্তক রহিয়াছে। সভাস্থলে যাঁহারা পিতার বা পিতৃস্থানীয় অভিভাবকের গৌরবযুক্ত পদবী গ্রহণ করেন, তাঁহারা শুনিয়া আতঙ্কিত হইবেন যে, এ পুরস্কার বিতরণে গ্রন্থ নির্বাচনের ভার আমার পিতৃদেবের উপর অর্পিত ছিল এবং তিনিই আমার গঞ্জাম গঞ্জাম, চত্বরপুর প্রভৃতি সূক্ষ্ম ভৌগোলিক তত্ত্বে পারদর্শিতার পুরস্কারস্বরূপ ঐ দুইখানি গ্রন্থ নির্বাচন করিয়া তাঁহার নবম বর্ষের পুত্রের হস্তে অর্পণ করিয়াছিলেন ।
পুরস্কারহস্তে বাড়ী আসিয়া রাত্রিটা একরকমে কাটাইয়াছিলাম, পরদিনে
বিষবৃক্ষ ও তার পরদিনে দুর্গেশনন্দিনী টাইটেলপেজের হেডিং মায় মূল্য পাঁচ সিকা হইতে শেষ পর্যন্ত
একরকমে উদরস্থ করি। এ দুটি গ্রন্থের কোন্ অংশ সর্বোৎকৃষ্ট
বোধ হইয়াছিল, তাহা যদি এখন অকপটে বলিয়া ফেলি,
তাহা হইলে নিশ্চয়ই আপনারা আমার কাব্যরসগ্রাহিতার প্রশংসা করিবেন না। বিষবৃক্ষের মধ্যে যেখানে ছেলের পাল “হীরার আয়ি
বুড়ী হাঁটে গুঁড়িগুঁড়ি” বলিয়া সেই
বৃদ্ধার পশ্চাদ্ধাবন করিয়াছিল ও বৃদ্ধার ইষ্টিরস নামক ব্যাধির প্রতিকার বিষয়ে কেষ্টরস নামক ওষুধের উপযোগিতা সম্বন্ধে প্রতিবেশীর
সহিত আলাপ করিতেছিল, সেই স্থানটাই
গ্রন্থের মধ্যে সবোৎকৃষ্ট বলিয়া সাব্যস্ত করিয়াছিলাম ।
গজপাতি বিদ্যাদিগগজকেই দুর্গেশনান্দনীর মধ্যে সর্বপ্রধান পাত্র স্থির করিয়াছিলাম, ইহাও নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করিতছি। আশমানীর ঘরে বিমলার আকাস্মিক প্রবেশের সহিত বিদ্যাদিগগজ ঘরের কোণে লুকাইয়৷ আত্মগোপন করিলেন, এবং তাহার শীর্ষরক্ষিত হাড়ি হইতে অড়হরের ডাল বিগলিত হইয়া অঙ্গপ্রত্যঙ্গে মন্দাকিনীর ধারা বহাইল, সেই বিবরণ যখনই পাঠ করিলাম, তখনই বুঝিলাম যে, বাঙ্গালা সাহিত্য অতি উপাদেয় পদার্থ; এই সাহিত্যের সরোবরে বিদ্যাদিগ্গজের মত শতদল কমল যখন বিদ্যমান আছে, তখন গঞ্জাম গঞ্জাম চত্বরপুরের কাঁটাবন ঠেলিয়াও সেই কমল চয়নের চেষ্টা অনুচিত নহে।
ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র
সম্বন্ধে এত লোকে এত কথা কহিয়াছেন যে আর সে বিষয়ে কোন কথিতব্য
আছে কি না, আমি জানি না। কথিতব্য থাকিলেও আমি কোন কথা বলিতে
সাহস করিব না। শ্রোতৃগণের মধ্যে অনেকেই হয়ত দাবী করিবেন যে, আমি যখন বঙ্কিমচন্দ্রের সম্বন্ধে প্রবন্ধপাঠে উদ্যত হইয়াছি, তখন
আমি সূর্যমুখীর ও ভ্রমরের চরিত্র আর
একবার সূক্ষ্মরূপে বিশ্লেষণ করিয়া উভয় চরিত্রের তুলনামূলক
সমালোচনে বাধ্য আছি। যদি কেহ এইরূপ দাবি রাখেন, তাহার নিকট আমি ক্ষমাভিক্ষা করিতেছি। বাঁকানল[৪] আর টেষ্টটিউব হাতে দিয়া নানাজাতি কিম্ভূতকিমাকার দ্রব্যের বিশ্লেষণ আমার ব্যবসায় বটে, কিন্তু মানবচরিত্র বা মানবীচরিত্র বিশ্লেষণে আমার কিছু মাত্র শিক্ষা বা দক্ষতা নাই;
কেন না, নভেল-বর্ণিত
মানবচরিত্র বিশ্লেষণে হাইড্রোজেনের[৫] কিছুমাত্র উপযোগিতা নাই; এ মানবচরিত্র নমনীয়ও নহে, দ্রবণীয়ও নহে এবং জলে দ্রব করিয়া
উত্তাপ প্রয়োগে উহার ভাসুরতাপাদনও অসম্ভব। আর আমার কাব্যরসগ্রাহিতার যে নমুনা দিয়াছ, তাহাতে
আপনারাও আমার নিকট সে আশা রাখেন না।
বঙ্কিকমচন্দ্রের
উপন্যাস সম্বন্ধে একটা স্থুল কথা আমার বলিবার আছে, সেই কথাটা সংক্ষেপে বলিয়াই আমি আপনাদিগকে রেহাই দিব ।
----------------------
[২] স্কট (১৭৭৮ – ১৮৩৪) – স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত কবি ও ঔপন্যাসিক। রোমান্স রচনায় বঙ্কিমকে ইঁহার অনুবর্তী মনে করা হয়।
[৩] ‘বিষবৃক্ষে’ হীরার সম্বন্ধে এই উক্তি আছে।
[৪] বিজ্ঞানের ল্যাবরেটরিতে ব্যবহৃত উপকরণ কাচের নল।
[৫] সালফরেট হাইড্রোজেন (Sulphuretted or Sulphuret Hydrogen) – উদজানের সহিত গন্ধকের রাসায়নিক মিশ্রণ।
(ক্রমশঃ ... দ্বিতীয় পর্ব)
চরিতকথা - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রচিত প্রবন্ধ 'বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' থেকে প্রশ্নোত্তর ও নোটসের আলোচনার জন্যে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল দেখুন।
0 মন্তব্যসমূহ