Header Ads Widget

WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা ** WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা **

ticker

6/recent/ticker-posts

চরিতকথা - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রচিত প্রবন্ধ 'বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' (৩য় পর্ব)

 চরিতকথা - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রচিত প্রবন্ধ

 'বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' (৩য় পর্ব) 

চরিতকথা - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী


পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ

    বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর, রজনী, আর কৃষ্ণকান্তের উইল, এই চারিখানি উপন্যাসের কথা আমি বলিতেছি এই চারিখানি গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এক । প্রতাপ ও নগেন্দ্র, অমরনাথ ও গোবিন্দলাল, সকলেই কুসুম শায়কের লক্ষ্য হইয়াছিলেন; ধর্মবুদ্ধির দৃঢ়তা ও প্রবৃত্তির তীব্রতার তারতম্যানুসারে কেহ বা জয় লাভ করিয়াছিলেন, কেহ বা পারেন নাই। বীর্যবন্ত প্রতাপ সারা-জীবন প্রবৃত্তির সহিত যুদ্ধ করিয়া সম্পূর্ণ জয়লাভ করিয়াছিলেন, তাহার মৃত্যুর পূর্বে তাহার জীবনব্যাপী কঠোর ও নীরব সাধনার বিষয় জগতের লোক জানিতে পারিয়াছিল । মোহমুগ্ধ অমরনাথ আপনার পিঠের উপর আকস্মিক পদস্খলনের স্থায়ী চিহ্ন ধারণ করিয়া তাহার স্বাভাবিক দম্ভের বলে পরবর্তী জীবনে সন্ন্যাসী সাজিয়া বেড়াইয়াছিলেন; পত্নীবৎসল নগেন্দ্রনাথ আপনার আত্মাকে ছিন্ন ভিন্ন বিদীর্ণ করিয়া অনাথা পিতৃহীনা বালিকার প্রতি দয়াপ্রকাশের ফল ভোগ করিয়াছিলেন; আর সর্বাপেক্ষা কৃপাপাত্র গোবিন্দলাল সর্বতোভাবে আপনার অনধীন ঘটনাচক্রের নিষ্ঠুর পেষণে নিষ্পিষ্ট হইয়া আপনাকে কলঙ্ক-হ্রদে নিমগ্ন করিয়া অবশেষে অপমৃত্যু-দ্বারা শান্তিলাভে বাধ্য হইয়াছিলেন।

     এই চারিটি মনুষ্যর বিভিন্ন দশার চিত্র সম্মুখে রাখিয়া আমরা কখনও মানবচরিত্রের মহিমা দেখিয়া স্পর্ধিত ও গর্বিত হইতে পারি, কখনও বা জাগতিক শক্তির সম্মুখে মানবের দৌর্বল্য দেখিয়া ভীত হইতে পারি। বঙ্কিমচন্দ্র মানবজীবনের ও জগদ্বিধানের এই সমস্যাএই গোড়ার কথা অতি সুন্দর চিত্রে চিত্রিত করিয়াছেন এবং এই জন্য তিনি উচ্চশ্রেণীর কবি

     জিকার দিনে বঙ্কিমচন্দ্রের অদৃশ্য হস্ত আমাদের জাতীয় জীবনকে যেরূপে নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত করিতেছে, তাহাতে ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র যতই উচ্চ স্থানে অবস্থান করুন, বঙ্কমচন্দ্রের অন্য মূর্তির পদপ্রান্তে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করিতে আজ ব্যগ্র হইব, ইহা স্বাভাবিকবঙ্কিমচন্দ্র কত দিক হইতে আমাদের জীবনের উপর প্রভুত্ব করিতেছেন, তাহার গণনা দুষ্কর। ইংরেজীতে একটা বাক্য চলিত হইয়াছে, যাহার মূলে গ্রীক নাই, সে জিনিস জগতে অচল। বলা বাহুল্য, এখানে জগৎ অর্থে কেবল পাশ্চাত্য দেশ বুঝায়। আমরা যদি এ বাক্যকে ঈষৎ পরিবর্তিত করিয়ালি যে, যাহার মূলে বঙ্কিমচন্দ্র নাই, সে জিনিস বাঙ্গলা দেশে অ, তাহা হইলে নিতান্ত অত্যুক্তি হইবে না। ইংরাজী গতিবিজ্ঞানে একটা শব্দ আছে— মোমেন্ট, বাঙ্গলায় উহাকে ‘ঝোঁক’ শব্দে অনুবাদ করিতে পারি। বঙ্কিমচন্দ্র যে কয়েকট৷ জিনিসকে ঝোঁক দিয়া ঠেলিয়া দিয়া গিয়াছেন, সেই কয়টা জিনিস বাঙ্গলা দেশে চলিতেছে। সেই জিনিসগুলা গত উপার্জনের জন্য যেন বঙ্কিমচন্দ্রের হস্তের প্রেরণার অপেক্ষায় ছিল; ঙ্কিমচন্দ্র হাত দিয়া ঠেলিয়া দিলেন, আর উহা চলিতে লাগিল, তাহার পর আর উহা থামে নাই।

    দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রথমে নবেলের কথাটাই ধরা যাক। বাঙ্কিমবাবুর পূর্বেও অনেকে বাঙ্গলা নবেল লিখিয়াছেন; তাহাতে কিসের যেন অভাব ছিল। ইংরেজীনবিশ অনেক লেখক ইংরেজী নবেলের অনুসরণে বাঙ্গালা নবেল লিখিয়াছিলেন; কিন্তু কি-একটা অভাবের জন্য উহা বাঙ্গলা-সাহিত্যে লাগে নাই। বঙ্কিমচন্দ্র নবেল লিখিলেন, আর এক দিনেই বাঙ্গালায় সাহিত্যের একটা নূতন শাখার সৃষ্টি হইল। স্রোতস্বতীর যে ক্ষীণ ধারা প্রবাহিত হইতেছি, এখন উহা নূতন পথ পাইয়া বিপুলকায় গ্রহণ করিয়া, শত উপশাখার সৃষ্টি করিয়া দেশ ভাসাইয়া জলপ্লাবন উপস্থিত করিলসকলেই জানেন যে, এই জলপ্লাবনে সাহিত্যক্ষেত্র ভাসিয়৷ যাইবার উপক্রম হইয়াছে। বলা বাহুল্য, বাঙ্গলার অধিকাংশ নবেলই অপেয়, অদেয় ও অগ্রাহ্য; কিন্তু ইহার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র দায়ী নহেন। ইহা দেশের দারিদ্রের ও দুরবস্থারই পরিচয় দেয়। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃতিত্বের ইহাতে অঙ্গহানি হয় না। এখন হয়ত বাঁধ বাঁধিয়া দেশকে এই প্লাবন হইতে রক্ষা করিবার সময় উপস্থিত হইয়াছে, কিন্তু এই মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতার দিনে সেইরূপ বাঁধ বাঁধিবার কোন উপায় দেখি না বঙ্কিমচন্দ্রের পর যাহারা নবেল লিখিয়াছেন, তাহারা যদি প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্রের অনুবর্তী হইয়া সৌন্দর্যসৃষ্টিকেই কাব্যরচনার মুখ্য উদ্দেশ্য করিতেন, তাহা হইলে আমাদের এতটা আতঙ্কিত হইবার সম্ভাবনা থাকিত না।

     বঙ্কিমচন্দ্রকেই আমরা এদেশে মাসিকপত্রের প্রবর্তক বলিয়া নির্দেশ করিতে পারি। বঙ্গদর্শনেপূর্বেও অনেক মাসিকপত্রিকা বাহির হইয়াছিল, কিন্তু তাহাতেও কি-যেন-কি একটার অভাব ছিল, তাই তাহারা সাহিত্যসমাজে প্রভূত্ব বিস্তার করিতে পারে নাই। বঙ্গদর্শনই প্রথমে ভবিষ্যতের মাসিকপত্রের রচনারীতি ও সঙ্কলনরীতি নির্দিষ্টরিয়া দিল; তদবধি সেই রীতি মাসিকপত্রের সম্পাদকগণ কর্তৃক অনুসৃত হইয়াছেইহার পূর্বে মাসিকপত্র দাঁড়াইয়া ছিল। বঙ্কিকমচন্দ্রের হস্তে প্রেরণা পাইয়াই মাসিকপত্র বঙ্গসাহিত্যে চলিতে লাগিল ।

     নবেলের মত এই মাসিক সাহিত্যও বিদেশ হইতে এদেশে আমদানি । এক দেশের গাছের বীজ আনিয়া অন্য দেশে উহার চাষের চেষ্টা বহু দিন হইতে প্রচলিত আছে। আজ ক্ষুব্ধ ভারতবর্ষ বিদেশের দ্রব্য গ্রহণ করিব না বলিয়া আস্ফালন করিতেছে, কিন্তু বিদেশী জিনিসকে স্বদেশে স্থান দিতে ভারতবর্ষের কোন কালে আপত্তি ছিল না। আলুর বীজ ও পেঁপের বীজ বিদেশ হইতেই এদেশে আসিয়াছিল; এবং আফিমের জন্য ও তামাকের জন্য ভারতবাসী বিদেশের নিকট চিরণে আবদ্ধ আছেন । অজ্ঞাতকুলশীল অতিথিকে আপন ঘরে স্থান দিতে ভারতবাসী কস্মিন্‌ কালে কুণ্ঠাবোধ করে নাই। বিদেশের সামগ্রী গ্রহণ করিতে আমাদের কোন কালেই ঔদার্যের অভাব ছিল না। বিদেশের সকল বীজ এদেশের ক্ষেতে ধরে না, কিন্তু কোন-কোনটা বেশ ধরিয়া যায়। কোন কোন বীজ ফলাইবার জনা চাষের প্রণালীকে ক্ষেতের অনুযায়ী করিয়া লইতে হয়। নবেলের বীজ ও মাসিক পত্রিকার বীজঙ্কিকমচন্দ্রের পূর্বেই আসিয়াছিল; —  যাহারা উহার আমদানি করিয়াছিলেন, তাহারা উহা ফলাইতে পারেন নাই। বঙ্কিমচন্দ্র যে দিন চাষের ভার গ্রহণ করিলেন, সেই দিন উহা জমিতে লাগিয়া গেল; এখন উহার শস্য-সম্পত্তিতে সুজলা সুফলা বঙ্গধরিত্রী ভারাক্রান্ত হইয়া পাড়িয়াছেন বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। আফিম এবং তামাক, এই দুই উপাদেয় ফসল এ দেশের জমিতে যেমন লাগিয়া গিয়াছে, নবেলের এবং মাসিক পত্রিকার শস্যসম্পদ্‌ কিছুতেই তাহার নিকট ন্যূনতা স্বীকার করিবে না।

    বাঙ্গালা নবেল-সাহিত্যের ও মাসিক-সাহিত্যের সৃষ্টি করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র যশস্বী হইয়া গিয়াছেন, কিন্তু তিনি তার অপেক্ষাও বড় কাজ করিয়া গিয়াছেনবাঙ্গলা-সাহিত্যে তাঁহার কোন্‌ কাজ সর্বাপেক্ষা বৃহৎ, তাহা জিজ্ঞাসা করিলে আমি বলিতিনি সাহিত্য উপলক্ষ্য করিয়া আমাদিগকে আপন ঘরে ফিরিতেলিয়াছেন এবং সে বিষয়ে তিনি যেমন কৃতকার্য হইয়াছেন, অন্য কেহই সেরূপ হন নাই। বিদেশের ভাষা অবলম্বন করিয়া আমরা যে বড় হইতে পারিব না, বিদেশের ভাষার সাহায্যে সাহিত্য সৃষ্টি করিয়া বড় হইবার চেষ্টা যে অস্বাভাবিক ও উপহাস্য, তাহা বঙ্কিমচন্দ্রই আমাদিগকে বুঝাইয়া গিয়াছেনঙ্কিমচন্দ্রের বহু পূর্বে মহাত্মা রামমোহন রায় দেশের লোকের সঙ্গে কথা কহিবার জন্য দেশের ভাষারই আশ্রয় লইয়াছিলেন; তিনি বাঙ্গলায় সাময়িক-পত্র প্রচার করেন, বাঙ্গলায় বেদান্তশাস্ত্র প্রকাশ করেন, দেশের লোকের মতিগতি ফিরাইবার জন্য দেশের লোকের অবোধ্য ভাষায় দেশের লোককে সম্বোধনের অদ্ভুত প্রণালী তাঁহার স্থিরবুদ্ধিসঙ্গত বলিয়া গ্রহণ করে নাই। এমন কি, তিনিই বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে বাঙ্গালাভাষায় প্রথম ও শেষ ব্যাকরণ লিখিয়া গিয়াছেন। রামমোহন রায় যাহা বুঝিয়াছিলেন, তাহার পরবর্তী বাঙ্গালীরা তাহা বুঝিতে পারেন নাই। হিন্দুকালেজ প্রাতষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপন্ন হইয়া গেল যে, হিন্দুস্থানে হিন্দুসন্তানের আশ্রয় বা অবলম্বন হিন্দুসন্তানের জ্ঞাতব্য বা রক্ষিতব্য কিছুই নাই। বর্বর জাতির প্রাচীন সাহিত্যে, ক্ষীরসমুদ্র ও দধিসমুদ্রের কথা ভিন্ন আর কোন কথা নাই সিদ্ধান্ত করিয়া লর্ড মেকলে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা আনয়ন করিলেন। বিদেশের এই নূতন আমদানি শিক্ষাকে এদেশের লোকে সমাদরে গ্রহণ করিল ও তাহার সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত করিয়া বসিল যে, এই বর্বরের ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টা সম্পর্ণ বৃথা হইবে। ইংরেজী শিক্ষার প্রথম ধাক্কা আমাদিগকে ঘর হইতে বাহিরে যাইয়া পরের দ্বারে ভিক্ষার্থীবেশে স্থাপিত করিয়াছিল, ঙ্কিমচন্দ্র আমাদিগকে আপন ঘরে ডাকিয়া আনেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় বাঙ্গলা ভাষাকে সংস্কৃত করিয়া উহাকে সাহিত্যসৃষ্টির উপযোগী করিয়াছিলেন, ঙ্কিমচন্দ্র উহাকে পুনঃসংস্কৃত করিয়া বাঙ্গলা সাহিত্যের সৃষ্ট করিয়া গিয়াছেন। ইংরেজী লিখিয়া যশস্বী হইবার অস্বাভাবিক দুরভিলাষের বন্ধন হইতে বঙ্কিমচন্দ্রই আমাদিগকে মুক্তি দিয়া গিয়াছেন

(ক্রমশঃ ... চতুর্থ পর্বে সমাপ্য) 

চরিতকথা - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রচিত প্রবন্ধ 'বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' থেকে প্রশ্নোত্তর ও নোটসের আলোচনার জন্যে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল দেখুন 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ