চরিতকথা - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রচিত প্রবন্ধ
'বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' (৩য় পর্ব)
পূর্ব প্রকাশিতের পরবর্তী অংশ
বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর, রজনী,
আর কৃষ্ণকান্তের উইল, এই চারিখানি উপন্যাসের
কথা আমি বলিতেছি। এই
চারিখানি গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এক । প্রতাপ ও নগেন্দ্র, অমরনাথ ও গোবিন্দলাল, সকলেই কুসুম শায়কের লক্ষ্য হইয়াছিলেন;
ধর্মবুদ্ধির দৃঢ়তা ও প্রবৃত্তির তীব্রতার তারতম্যানুসারে কেহ বা জয়
লাভ করিয়াছিলেন, কেহ বা পারেন নাই। বীর্যবন্ত প্রতাপ
সারা-জীবন প্রবৃত্তির সহিত যুদ্ধ করিয়া সম্পূর্ণ জয়লাভ করিয়াছিলেন, তাহার মৃত্যুর পূর্বে তাহার জীবনব্যাপী কঠোর ও নীরব সাধনার বিষয় জগতের
লোক জানিতে পারিয়াছিল । মোহমুগ্ধ অমরনাথ আপনার পিঠের উপর আকস্মিক পদস্খলনের
স্থায়ী চিহ্ন ধারণ করিয়া তাহার স্বাভাবিক দম্ভের বলে পরবর্তী জীবনে সন্ন্যাসী
সাজিয়া বেড়াইয়াছিলেন; পত্নীবৎসল নগেন্দ্রনাথ আপনার
আত্মাকে ছিন্ন ভিন্ন বিদীর্ণ করিয়া অনাথা পিতৃহীনা বালিকার প্রতি দয়াপ্রকাশের ফল
ভোগ করিয়াছিলেন; আর সর্বাপেক্ষা কৃপাপাত্র গোবিন্দলাল সর্বতোভাবে
আপনার অনধীন ঘটনাচক্রের নিষ্ঠুর পেষণে নিষ্পিষ্ট হইয়া আপনাকে কলঙ্ক-হ্রদে নিমগ্ন
করিয়া অবশেষে অপমৃত্যু-দ্বারা শান্তিলাভে বাধ্য হইয়াছিলেন।
দৃষ্টান্তস্বরূপ প্রথমে নবেলের কথাটাই ধরা যাক। বাঙ্কিমবাবুর
পূর্বেও অনেকে বাঙ্গলা নবেল লিখিয়াছেন; তাহাতে কিসের যেন অভাব ছিল। ইংরেজীনবিশ অনেক লেখক
ইংরেজী নবেলের অনুসরণে বাঙ্গালা নবেল লিখিয়াছিলেন; কিন্তু কি-একটা অভাবের জন্য উহা
বাঙ্গলা-সাহিত্যে লাগে নাই। বঙ্কিমচন্দ্র নবেল লিখিলেন, আর এক দিনেই বাঙ্গালায় সাহিত্যের একটা নূতন শাখার সৃষ্টি হইল। স্রোতস্বতীর যে ক্ষীণ ধারা
প্রবাহিত হইতেছিল, এখন উহা নূতন পথ পাইয়া বিপুলকায় গ্রহণ করিয়া, শত উপশাখার
সৃষ্টি করিয়া দেশ ভাসাইয়া জলপ্লাবন উপস্থিত করিল। সকলেই জানেন যে, এই জলপ্লাবনে সাহিত্যক্ষেত্র ভাসিয়৷ যাইবার উপক্রম হইয়াছে। বলা বাহুল্য, বাঙ্গলার
অধিকাংশ নবেলই অপেয়, অদেয় ও অগ্রাহ্য;
কিন্তু ইহার জন্য বঙ্কিমচন্দ্র দায়ী নহেন।
ইহা দেশের দারিদ্রের ও দুরবস্থারই পরিচয় দেয়। বঙ্কিমচন্দ্রের কৃতিত্বের ইহাতে অঙ্গহানি হয় না। এখন হয়ত বাঁধ বাঁধিয়া দেশকে এই প্লাবন হইতে রক্ষা করিবার সময়
উপস্থিত হইয়াছে, কিন্তু এই মুদ্রাযন্ত্রের স্বাধীনতার দিনে সেইরূপ বাঁধ বাঁধিবার কোন উপায় দেখি না। বঙ্কিমচন্দ্রের পর যাহারা
নবেল লিখিয়াছেন, তাহারা যদি
প্রকৃতপক্ষে বঙ্কিমচন্দ্রের অনুবর্তী হইয়া সৌন্দর্যসৃষ্টিকেই কাব্যরচনার মুখ্য উদ্দেশ্য করিতেন, তাহা হইলে আমাদের
এতটা আতঙ্কিত হইবার সম্ভাবনা থাকিত না।
নবেলের মত এই মাসিক সাহিত্যও বিদেশ হইতে এদেশে আমদানি । এক দেশের গাছের বীজ আনিয়া অন্য দেশে উহার চাষের চেষ্টা বহু দিন হইতে প্রচলিত আছে। আজ ক্ষুব্ধ ভারতবর্ষ বিদেশের দ্রব্য গ্রহণ করিব না বলিয়া আস্ফালন করিতেছে, কিন্তু বিদেশী জিনিসকে স্বদেশে স্থান দিতে ভারতবর্ষের কোন কালে আপত্তি ছিল না। আলুর বীজ ও পেঁপের বীজ বিদেশ হইতেই এদেশে আসিয়াছিল; এবং আফিমের জন্য ও তামাকের জন্য ভারতবাসী বিদেশের নিকট চিরঋণে আবদ্ধ আছেন । অজ্ঞাতকুলশীল অতিথিকে আপন ঘরে স্থান দিতে ভারতবাসী কস্মিন্ কালে কুণ্ঠাবোধ করে নাই। বিদেশের সামগ্রী গ্রহণ করিতে আমাদের কোন কালেই ঔদার্যের অভাব ছিল না। বিদেশের সকল বীজ এদেশের ক্ষেতে ধরে না, কিন্তু কোন-কোনটা বেশ ধরিয়া যায়। কোন কোন বীজ ফলাইবার জনা চাষের প্রণালীকে ক্ষেতের অনুযায়ী করিয়া লইতে হয়। নবেলের বীজ ও মাসিক পত্রিকার বীজ বঙ্কিকমচন্দ্রের পূর্বেই আসিয়াছিল; — যাহারা উহার আমদানি করিয়াছিলেন, তাহারা উহা ফলাইতে পারেন নাই। বঙ্কিমচন্দ্র যে দিন চাষের ভার গ্রহণ করিলেন, সেই দিন উহা জমিতে লাগিয়া গেল; এখন উহার শস্য-সম্পত্তিতে সুজলা সুফলা বঙ্গধরিত্রী ভারাক্রান্ত হইয়া পাড়িয়াছেন বলিলেও অত্যুক্তি হইবে না। আফিম এবং তামাক, এই দুই উপাদেয় ফসল এ দেশের জমিতে যেমন লাগিয়া গিয়াছে, নবেলের এবং মাসিক পত্রিকার শস্যসম্পদ্ কিছুতেই তাহার নিকট ন্যূনতা স্বীকার করিবে না।
বাঙ্গালায় নবেল-সাহিত্যের
ও মাসিক-সাহিত্যের সৃষ্টি করিয়া বঙ্কিমচন্দ্র যশস্বী হইয়া গিয়াছেন, কিন্তু তিনি তার অপেক্ষাও বড় কাজ করিয়া গিয়াছেন। বাঙ্গলা-সাহিত্যে তাঁহার কোন্ কাজ সর্বাপেক্ষা বৃহৎ, তাহা জিজ্ঞাসা করিলে
আমি বলিব তিনি সাহিত্য উপলক্ষ্য করিয়া আমাদিগকে
আপন ঘরে ফিরিতে বলিয়াছেন এবং সে
বিষয়ে তিনি যেমন কৃতকার্য হইয়াছেন, অন্য
কেহই সেরূপ হন নাই। বিদেশের ভাষা অবলম্বন করিয়া আমরা যে বড় হইতে পারিব না, বিদেশের ভাষার সাহায্যে সাহিত্য সৃষ্টি করিয়া বড়
হইবার চেষ্টা যে অস্বাভাবিক ও উপহাস্য, তাহা বঙ্কিমচন্দ্রই আমাদিগকে
বুঝাইয়া গিয়াছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের বহু পূর্বে মহাত্মা রামমোহন রায় দেশের লোকের সঙ্গে কথা
কহিবার জন্য দেশের ভাষারই আশ্রয় লইয়াছিলেন; তিনি বাঙ্গলায় সাময়িক-পত্র প্রচার করেন, বাঙ্গলায় বেদান্তশাস্ত্র প্রকাশ করেন, দেশের লোকের মতিগতি ফিরাইবার জন্য দেশের লোকের অবোধ্য ভাষায় দেশের লোককে সম্বোধনের অদ্ভুত প্রণালী তাঁহার স্থিরবুদ্ধিসঙ্গত বলিয়া গ্রহণ করে নাই। এমন কি, তিনিই বৈজ্ঞানিক প্রণালীতে বাঙ্গালাভাষায় প্রথম ও শেষ ব্যাকরণ লিখিয়া গিয়াছেন। রামমোহন রায় যাহা
বুঝিয়াছিলেন, তাহার
পরবর্তী বাঙ্গালীরা তাহা বুঝিতে পারেন নাই। হিন্দুকালেজ প্রাতষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিপন্ন হইয়া
গেল যে, হিন্দুস্থানে হিন্দুসন্তানের আশ্রয় বা অবলম্বন হিন্দুসন্তানের জ্ঞাতব্য বা রক্ষিতব্য কিছুই নাই। বর্বর জাতির প্রাচীন সাহিত্যে, ক্ষীরসমুদ্র
ও দধিসমুদ্রের কথা ভিন্ন আর কোন কথা নাই সিদ্ধান্ত করিয়া লর্ড মেকলে এদেশে পাশ্চাত্য শিক্ষা
আনয়ন করিলেন। বিদেশের এই নূতন আমদানি
শিক্ষাকে এদেশের লোকে সমাদরে গ্রহণ করিল ও
তাহার সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত করিয়া বসিল যে, এই বর্বরের ভাষায় সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টা সম্পর্ণ বৃথা হইবে। ইংরেজী শিক্ষার প্রথম ধাক্কা আমাদিগকে ঘর হইতে বাহিরে যাইয়া পরের
দ্বারে ভিক্ষার্থীবেশে স্থাপিত করিয়াছিল, বঙ্কিমচন্দ্র আমাদিগকে আপন ঘরে
ডাকিয়া আনেন। বিদ্যাসাগর মহাশয় বাঙ্গলা ভাষাকে সংস্কৃত করিয়া উহাকে সাহিত্যসৃষ্টির উপযোগী করিয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্র উহাকে পুনঃসংস্কৃত করিয়া বাঙ্গলা সাহিত্যের সৃষ্ট করিয়া গিয়াছেন। ইংরেজী লিখিয়া যশস্বী হইবার অস্বাভাবিক দুরভিলাষের বন্ধন হইতে বঙ্কিমচন্দ্রই আমাদিগকে মুক্তি দিয়া গিয়াছেন।
(ক্রমশঃ ... চতুর্থ পর্বে সমাপ্য)
চরিতকথা - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রচিত প্রবন্ধ 'বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' থেকে প্রশ্নোত্তর ও নোটসের আলোচনার জন্যে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল দেখুন।
0 মন্তব্যসমূহ