Header Ads Widget

WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা ** WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা **

ticker

6/recent/ticker-posts

সুলেখার ক্রন্দন - বনফুলের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প

সুলেখার ক্রন্দন  
বনফুলের শ্রেষ্ঠ ছোটগল্প

সুলেখার ক্রন্দন - বনফুল


সুলেখার ক্রন্দন

 

সুলেখা কাঁদিতেছে।

গভীর রাত্রি, বাহিরে জ্যোৎস্নায় ফিনিক ফুটিতেছে। এই স্বপ্নময় আবেষ্টনীর মধ্যে দুগ্ধফেননিভ শয্যায় উপুড় হইয়া শুইয়া ষোড়শী তন্বী সুলেখা অঝোরে কাঁদিতেছে। একাঘরে আর কেহ নাই। চুরি করিয়া একফালি জ্যোৎস্না জানালা দিয়া ঘরে প্রবেশ করিয়াছে। প্রবেশ করিয়া এই ব্যথাতুরা অশ্রুমুখী রূপসীকে দেখিয়া সে যেন থমকিয়া দাড়াইয়া আছে। কেন এ ক্রন্দন?

প্রেম? হইতে পারে বইকি। এই জ্যোৎস্না-পুলকিতা যামিনীতে সুন্দরী ষোড়শীর নয়নপল্লবে অশ্রুসঞ্চারের কারণ প্রেম হইতে পারে। সুলেখার জীবনে প্রেম একবার আসি-আসি করিয়াছিল তো! তখনও তাহার বিবাহ হয় নাই। অরুণদা নামক যুবকটিকে সে মনে মনে শ্রদ্ধা করিতঅতীব সঙ্গোপনে এবং মনে মনে। এই শ্রদ্ধাই স্বাভাবিক নিয়মে প্রেমে পরিণত হইতে পারিত, কিন্তু সামাজিক নিয়ম তাহাতে বাধা দিল। সামাজিক নিয়ম অনুসারে অরুণদা নয়, বিপিন নামক জনৈক ব্যক্তির লোমশ গলদেশে সুলেখা বর-মাল্য অর্পণ করিল।

হয়তো এই গভীর রাত্রিতে জ্যোৎস্নার আবেশে সেই অরুণদাকেই তাহার বার বার মনে পড়িতেছে। নির্জন শয্যায় তাহারই স্মরণে হয়তো এই অশ্রু-তর্পণ! তবে ইহাও ঠিক যে, তাহার গোপন হৃদয়ের ভীরু বার্তাটি সে অরুণদাকে কখনও জানায় নাই। মনে মনে তাহার যে আগ্রহ ও আকাঙ্ক্ষা জাগিয়া উঠিয়াছিল, বিবাহের পর তাহা ধীরে ধীরে কালের অমোঘ নিয়মানুসারে আপনিই নিবিয়া গিয়াছে।

বিপিন যদিও অরুণদা নয়, কিন্তু বিপিনবিপিন।একেবারে খাঁটি বিপিন। এবং আশ্চর্যের বিষয় হইলেও ইহা সত্য কথা যে, বিপিনের বিপিনত্বকে সুলেখা ভালোবাসিয়াছিল। ভালোবাসিয়া সুখীও হইয়াছিল। সহসা আজ নিশীথে সেই বিস্মৃতপ্রায অরুণদাকে মনে পড়িয়া আঁখিপল্পব সজল হইয়া উঠিবে, সুলেখার মন কি এতটা অতীতপ্রবণ?

হইতে পারে। নারীর মন বিচিত্র। তাহাদের মনস্তত্ত্বও অদ্ভুত। সে সম্বন্ধে চট করিয়া কোনও মন্তব্য করা উচিত মনে করি না। বস্তুত স্ত্রী-জাতির সম্বন্ধে কোনও কিছু মন্তব্য করাই দুঃসাহসের কার্য। যে রমণীকে দেখিয়া মনে হয় বয়স বোধ হয় উনিশ-কুড়িঅনুসন্ধন করিয়া জানা গিয়াছে তাহার বয়স পঁয়ত্রিশ। এতদনুসারে সাবধানতা অবলম্বন করিয়া পুনরায় কাহারও বয়স যখন অনুমান করিলাম পঁচিশ, প্রমাণিত হইয়া গেল তাহার বয়ঃক্রম পনর বৎসরের এক মিনিট অধিক নয়।

সুতরাং নারী সংক্রান্ত কোনও ব্যাপারে বেকুবের মতো ফস্‌ করিয়া কিছু একটা বলিয়া বসা ঠিক নয়। সর্বদাই ভদ্রভাবে ইতস্তত করা সঙ্গত। ইহাই সার বুঝিয়াছি এবং সেই জন্যই সুলেখার ক্রন্দন সম্বন্ধে সহসা কিছু বলিব না। কারণ আমি জানি না। ক্রন্দনের শোভন ও সঙ্গত কারণ যতগুলি হওয়া সম্ভব তাহাই বিবৃত করিতেছি।

গভীর রাত্রে একা ঘরে একটি যুবতী শয্যায় শুইয়া ক্রমাগত কাঁদিয়া চলিয়াছেইহা একটি ডিটেক্টিভ উপন্যাসের প্রথম পরিচ্ছেদের বিষয়ও হইতে পারে। কিন্তু আমরা বিশ্বস্তসূত্রে অবগত আছি, তাহা নয়। পাঠক-পাঠিকাগণ এ বিষয়ে অন্তত নিশ্চিন্ত হউন। বিপিন এবং সুলেখাকে যত দূর জানি, তাহাতে তাহাদের ডিটেক্টিভ উপন্যাসের নায়ক-নায়িকা হইবার মতো যোগ্যতা আছে বলিয়া মনে হয় না।

অরুণদার কথা ছাড়িয়া দিলে সুলেখার ক্রন্দনের আর একটি সম্ভাবনার কথা মনে হইতেছে। কিছুদিন পূর্বে সুলেখার একটি সন্তান হইয়াছিল। তাহার প্রথম সন্তান। সেটি হঠাৎ মাস দুই পূর্বে ডিপথিরিয়াতে মারা গিয়াছে। হইতে পারে সেই শিশুর মুখখানি সুলেখার জননী-হৃদয়কে কাঁদাইতেছে। শিশুটির মৃত্যুর পর সুলেখার দুই দিন ফিটহয়ইহা তো আমরা বিশ্বস্তসূত্রে জানি। চিরকালের জন্য যাহা হারাইয়া গিয়াছে, তাহাকে ক্ষণিকের জন্যও ফিরিয়া পাইবার আকুলতা কঠোর পুরুষের মনেও মাঝে মাঝে হয়। কোমলহৃদয়া রমণীর অন্তঃকরণে তাহা হওয়া কিছুমাত্র বিচিত্র নহে। ক্রন্দনের কারণ পুত্রশোক হইতে পারে। অবশ্যই হইতে পারে।

কিন্ত হ্যাঁ, আর একটা কারণও তো হইতে পারে। পুত্রশোক-প্রসঙ্গের পর এই কথাটি বলিতেছি বলিয়া আপনারা আমাকে ক্ষমা করুন; কিন্তু সুলেখার ত্রন্দনের এই তুচ্ছ সম্ভাবনাটা আমি উপেক্ষা করিতে পারিলাম না। বিগত কয়েক দিবস হইতে একটি নামজাদা ছবি স্থানীয় সিনেমা-হাউসে দেখানো হইতেছে। পাড়ার যাবতীয় নর-নারী সদলবলে গিয়া ছবিটি দেখিয়া আসিয়াছেন এবং উচ্ছসিত হইয়া প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করিতেছেন। কিন্ত বিপিন লোকটি এমনই বেরসিক যে, সুলেখার বারম্বার অনুরোধ সত্তেও সে সুলেখাকে উক্ত ছবি দেখাইতে লইয়া যায় নাই। প্রাঞ্জল ভাষায় প্রত্যাখ্যান করিয়াছে। সুলেখার যাহা ভালো লাগে, প্রায়ই দেখা যায় বিপিনের তাতে রাগ হয়। আশ্চর্য লোক এই বিপিন! কিছুক্ষণ আগেই সিনেমার লাস্ট শো হইয়া গিয়াছে। সুলেখার শয়নঘরের বাতায়নের নীচে দিয়াই সিনেমাতে যাইবার পথ। দর্শকের দল খানিকক্ষণ আগেই এই রাস্তা দিয়া সোল্লাসে হল্লা করিতে করিতে বাড়ি ফিরিল। হয়তো তাহাতেই সুলেখার সিনেমা-শোক উথলিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু সে একা কেন? বিপিন কোথায়? সে কি বেগতিক দেখিয়া এই গভীর রাত্রেই কল্যকার জন্যসীট বুককরিতে গিয়াছে?

হইতে পারে। তরুণী পত্নীকে শান্ত করিবার জন্য মানুষ সব করিতে পারে। হোক না বিপিন লোমশ, সে মানুষ তো! তাহা ছাড়া বিপিন সুলেখাকে সত্যই ভালোবাসিতইহাও আমরা বিশ্বস্তসূত্রে অবগত আছি। কারণ আমরালেখকরাঅনেক কথাই বিশ্বস্তসূত্রে অবগত থাকি। সুতরাং এই ত্রন্দন সিনেমা-ঘটিত হওয়াও কিছুমাত্র অসম্ভব নহে।

সবই হওয়া সম্ভব। বাস্তবিক, যতই ভাবিতেছি ততই আমার বিশ্বাস হইতেছে সুলেখার ক্রন্দনের হেতু সবই হইতে পারে। এমন কি আজও সন্ধ্যাকালে সামান্য একটা কাপড়ের পাড় পছন্দ-করা প্রসঙ্গে সুলেখার সহিত বিপিনের সাংঘাতিক মততেদ হইয়া গিয়াছে। রূঢ়ভাষী পুরুষমানুষেরা সাধারণত যাহা করে বিপিন তাহাই করিয়াছে। গলার জোরেঅর্থাৎ চিৎকার করিয়া জিতিয়াছে। মৃদুভাষিণী তরুণীগণ সাধারণতঃ যে উপায়ে জিতিয়া থাকেন, সুলেখা সম্ভবত তাহাই অবলম্বন করিয়াছেঅর্থাৎ কাঁদিতেছে।

কারণ যাহাই হউক, ব্যাপরটা নিঃসন্দেহে করুণ। রাত্রি গভীর এবং জ্যোৎস্না মনোহারিণী হওয়াতে আরও করুণঅর্থাৎ করুণতর। কোনও সহদয় পাঠক কিংবা পাঠিকা যদি ইহাকে করুণতমও বলেন তাহা হইলেও আমার প্রতিবাদ করিবার কিছু পাবে না। কারণ সুলেখা তরুণী রাত্রি যতই নিবিড় এবং জ্যোৎস্না যতই আকাশপ্লাবিনী হউক না কেন, এ বিষয়ে খুব সম্ভবত আমরা একমত যে, এই রাত-দুপুরে একটা বালক কিংবা একটা  বুড়ি কাঁদিলে আমরা এতটা আর্দ্র হইতাম না, উপরন্ত হয়তো বিরক্তই হইতাম।

সুলেখা কিন্তু তরুণী মন সুতরাং দ্রব হইয়াছে এবং কথাও অস্বাকীর করিবার উপায় নাই যে, সুলেখার ক্রন্দনের কারণ না নির্ণয় করা পর্যন্ত স্বস্তি পাইতেছি না এমনকি অরুণদাকে জড়াইয়া একটা সস্তা গোছের কাব্য করিতেও মন উৎসুক হইয়া উঠিয়াছে মন বলিতেছে, “কেন নয়? এমন চাঁদনী রাতে কৈশোরের সেই অর্ধ প্রস্ফুটিত প্রণয়-প্রসূন সহসা পূর্ণ-প্রস্ফুটিত হইতে পারে নাকি? ওই তো দূরে চোখ গেলপাখি অশ্রান্ত সুরে ডাকিয়া চলিয়াছে। সম্মুখের বাগানে রজনীগন্ধা স্বপ্ন-বিহ্বল! চতুর্দিকে জ্যোস্নার পাথার! এমন দুর্লভক্ষণে অরুণদার কথা মনে হওয়া কি অসম্ভব, না, অপরাধ?” মনের বক্তৃতা বন্ধ করিয়া কপাটটা হঠাৎ খুলিয়া গেল ব্যস্ত-সমস্ত বিপিন প্রবেশ করিল। মুখে শঙ্কার ছায়া সিনেমার টিকিট পায় নাই সম্ভবত। কিন্ত এ কি!

বিপিন জিজ্ঞাসা করিল— “দাঁতের ব্যথাটা কমেছে?”

না, বড্ড কনকন করছে

এই পুরিয়াটা খাও তা হলে। ভাক্তারবাবু কাল সকালে আসবেন বললেন, কেঁদে আর কি হবে! এটা খেলেই সেরে যাবে। খাও, লক্ষ্মীটি!”

জ্যোৎস্নার টুকরাটি মুচকি মুচকি হাসিতেছে।

দেখিলেন তো? বলিয়াছিলাম, সবই সম্ভব!


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ