অনুবাদচর্চার প্রয়োজনীয়তা
বিখ্যাত জার্মান কবি-দার্শনিক গেটের এক বয়োজ্যেষ্ঠ বন্ধু হার্ভারই
সর্বপ্রথম বিশ্বসংস্কৃতি নামে এক ধারণার কথা বলেন। একটি বিশেষ দেশের সংস্কৃতি যদি রাজনৈতিক, ভৌগোলিক
বা অন্য কোনো কারণে অন্যদেশে ছড়াতে না পারে, বা অন্যদেশের
সংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য গুণগুলিকে আত্মগত করতে না পারে, তাহলে
সেই সংস্কৃতির বিকাশ রুদ্ধ হয়ে যায়। অর্থাৎ সেই সংস্কৃতির প্রাণশক্তি অন্যদেশের সংস্কৃতির সঙ্গে যদি বিনিময় করার ক্ষমতা
হারিয়ে ফেলে তাহলে তার সমৃদ্ধি এবং বিকাশ রুদ্ধ হতে বাধ্য। এই বিনিময়ক্ষেত্রে
বিভিন্ন দেশের সৃষ্টিকর্ম এবং চিন্তাভাবনার পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া হবে। কিন্তু সঙ্গে-সঙ্গেই এটিও মনে রাখতে হবে যে, প্রত্যেক
দেশেরই আলাদাভাবে জাতীয় সংস্কৃতি বলে একটা বিশেষ চরিত্র আছে। সেই পৃথক চরিত্রকে মেনে
নিয়েই সেইসব আলাদা আলাদা সংস্কৃতির মিলগুলিকে খুঁজে নিয়ে কাছাকাছি আনতে হবে এবং
তাদের ভিতরকার গ্রহণযোগ্য বিষয়গুলিকে গ্রহণ করতে হবে। অর্থাৎ এক কথায়, পারস্পরিকভাবে বিনিময় করতে হবে। কাজেই একটি বিশেষ ভাষার লেখকের কাজ হবে
তীর নিজের ভাষার ভাবনাচিন্তা এবং প্রকাশভঙ্গির যেসব বৈশিষ্ট্য তাঁদের সৃষ্টিকর্মে
প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলিকে অন্যদেশের লেখক ও পাঠকদের সামনে
মেলে ধরা, যদি কোনো ভাষা সাহিত্যিক ঐতিহ্যে, সৃষ্টিকর্মে, দক্ষতায় অন্যদেশের তুলনায় কম সমৃদ্ধ
হয় তাহলে সেই দেশের সাহিত্য অন্যান্য সব সমৃদ্ধ দেশের সাহিত্যের লেখক একটি ব্যাপক
প্রেক্ষাপটের সামনে দাঁড়িয়ে তাদের নিজেদের সৃষ্টিকর্মের ঘাটতি পূরণ করতে পারেন
এবং সেই বিনিময়ের সাহায্যে পারস্পরিক আদান-প্রদানের মধ্যে দিয়ে আমরা সকলেই সমৃদ্ধ
হতে পারি। ভারতবর্ষের মতো বহুভাষী দেশের মানুষদের মধ্যে পারস্পরিক
এক্যবোধ জাগরুক করার জন্য ও ব্যাপক ও সুষ্ঠু অনুবাদকর্মের একটা গুরুত্বপূর্ণ
ভূমিকাও যে আছে, সে কথাও এখানে একান্তভাবেই স্মরণযোগ্য।
তবে একটি কোনো সাহিত্যের এলাকাভুক্ত লেখকের
পক্ষে বহুদেশের সাহিত্য আয়ত্ত করা কখনোই সম্ভব নয়। কেননা বহুদেশের সাহিত্য আয়ত্ত করতে গেলে বহুভাষাবিদ্ হতে হবে। সাধারণভাবে,
প্রত্যেকটি সাহিত্য পাঠকের পক্ষেও অনেকগুলি ভাষা শেখা সম্ভব নয়।
সমস্ত সাংস্কৃতিক বলয়েই দু-চারজনই থাকেন যাঁরা একাধিক
ভাষায় দক্ষতা অর্জন করতে পারেন। সেইজন্যই গ্যেটে পারস্পরিক ভাবনার বিনিময়ের
ক্ষেত্রে সাহিত্যের অনুবাদের আশ্রয় নিতে চেয়েছিলেন। অবশ্য তিনি এটা ভালোভাবেই
জানতেন যে, যে-কোনো সাহিত্যেই ‘ভালো’
অনুবাদ দুর্লভ | (এখানে প্রচলিত একটি ইতালীয়
প্রবচন স্মরণীয় “অনুবাদ যদি সুন্দরী হয়, তাহলে তাকে
অবিশ্বস্তা হতেই হবে এবং বিশ্বাসভাজন হলে, কুদর্শনা হতেই হবে
তাকে!”) কিন্তু তা সত্বেও, অনুবাদ আমাদের করতে হবে এবং
অনুবাদের মাধ্যমে যে-সমস্ত সমস্যার উদ্ভব হয়, সেগুলির সন্বন্ধেও সচেতন থাকতে হবে। কেননা, প্রত্যেক
ভাষারই নিজস্ব কিছু সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য থাকে এবং তার প্রেক্ষাপটে সাহিত্যের
মধ্যেও এমন কিছু বৈশিষ্ট্য ও প্রকাশভঙ্গির সক্রিয়তা থাকে, সেগুলিকে
অন্যদেশের ভাষায় অনুবাদ করা খুবই সমস্যার ব্যাপার।
আগেই বলা হয়েছে যে, দেশ-কালের
দূরত্ব মোচনের যে কয়েকটি উপায় আমাদের জানা আছে, তার মধ্যে
অনুবাদ একদিক থেকে সবচেয়ে কার্যকরী । লেখক এবং তীর ভাষা যখন প্রাচীন, তখন তাঁকে সমকালীন জীবনের মধ্যে সংকলিত করার কাজও এক অর্থে অনুবাদকেরই
দায়িত্ব বলে স্বীকার্য, অনুবাদই সেই ঘটক, যার প্রণোদনার মধ্যে দিয়ে আমরা বুঝতে পারি যে প্রাচীন সাহিত্য একটা
বৃহদায়তন স্থাবর সম্পত্তি নয়, যুগে-যুগে তা জঙ্গম হয়ে ভাব-বাণিজ্যের যোগ্য বলেই আমরা তাকে ‘ক্লাসিক’
বা ধ্রুপদী নাম দিয়েছি এবং আমাদের আজকের দিনের সম্পূর্ণ এই ভিন্ন
পরিবেশেও তার সংলগ্নতা বা প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে যায়নি।
অর্থাৎ বলা যেতে পারে, অনুবাদ সেই প্রাচীনকে সজীব ও সমকালীন
সাহিত্যের অংশ করে তোলে। আর সেইজন্যই যুগে-যুগে নতুন অনুবাদের প্রয়োজন হয়।
যেহেতু ভাষাই সাহিত্যের বাহন, তাই কোনো একটি অনুবাদ চিরকাল
ধরে পর্যাপ্ত বলে গণ্য থাকে না, প্রত্যেকটি যুগ তার সমকালীন
ভাষার যে বিশেষ ভঙ্গির এবং ভাবনার যে বিশিষ্ট চরিত্রের জন্ম দেয়, তার মধ্যে দিয়েই পুরোনো অনুবাদের পুনরুজ্জীবন ঘটে থাকে। ইউরোপের বিভিন্ন
ভাষাগুলিতে গ্রিক ও লাতিন সাহিত্যের প্রচুর অনুবাদ প্রতি যুগেই হয়ে আসছে এবং তার
ফলে সংশ্লিষ্ট ভাষাগুলির উত্তরোত্তর সমৃদ্ধিই ঘটেছে।
আবার অন্যভাবে দেখলে এটাই বলতে হয় যে, অধিকাংশ পাঠকের পক্ষেই অন্যভাষার মূল রচনা পড়া সম্ভবপর হয় না বলে
অনুবাদের প্রয়োজন হয়। অনেক সময় এক-একটি অনুবাদ এক-একটি দেশ বা মহাদেশের
সাহিত্যের ধারা বদলে দিয়েছে, এমনকি যারা মূল রচনার সঙ্গে পরিচিত, তারাও অনেক সময়েই ভালো
অনুবাদ পড়ে লাভবানই হন। কারণ ভালো অনুবাদ শুধুমাত্র মূল
রচনার প্রতিনিধিত্বই করে না, তার যুগ ও অনুবাদকের নিজস্ব ব্যক্তিত্বের স্বাদও পাঠককে উপলব্ধি করায়। এখানে
একটা তাত্ত্বিক প্রশ্নও অবশ্য ওঠে “গুড ট্রানস্লেশান ইজ আ্যাকচুয়ালি গুড ট্র্যানসক্রিয়েশান” (ভালো অনুবাদ বস্তৃতপক্ষে নতুন একটি রূপসৃষ্টিই)
এই তত্বগত অবস্থানটিকেও মেনে নিতে হয় সুসাহিত্যপাঠের খাতিরে। এই ‘নতুন রূপসৃষ্টি’ বা ট্র্যানসক্রিয়েশান কিন্তু নির্বাধন স্বাধীনতার ছাড়পত্র দেয় না; মূল
সৃষ্টির ভাব সৌন্দর্যকে অনাহত রেখেই কিন্তু যে-সংস্কৃতি বলয়ের ভাষায় তার ‘অনুবাদ’ তথা ‘নতুন রূপায়ণ’
করা হয়েছে, তার শৈলী ও রুচি মর্জিকে সেখানে
সংলগ্ন করতে হবে। আন্তন চেখভের নাটক ‘চেরি
অর্চার্ড’-কে অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘মঞ্জরী, আমের মঞ্জরী’-তে
যেভাবে রূপায়িত করেছেন, সেটি ট্ট্যানসক্রিয়েশ্যন-এর একটি
ভালো নিদর্শন।
0 মন্তব্যসমূহ