বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস সম্বন্ধে একটা স্থুল কথা
আমার বলিবার আছে, সেই কথাটা সংক্ষেপে বলিয়াই আমি
আপনাদিগকে রেহাই দিব ।
এক শ্রেণীর সমালোচক আছেন, তাহারা বলেন, মানবসমাজে সুখ দুঃখ, রেষারেষি, দ্বেষাদ্বেষি এবং
ভালবাসাবাসি যথাযথরূপে চিত্রিত করাই নবেলের মুখ্য উদ্দেশ্য;
উহাতে কল্পনার খেলার অবসর নাই। ইঁহারা বঙ্কিমচন্দ্রের উপর সম্পূর্ণ
প্রসন্ন নহেন। আর এক শ্রেণীর সমালোচক বলেন, পাপ-পুণ্যের ফলাফলের
তারতম্য দেখাইয়া সমাজের নীতিশিক্ষার ও ধর্মশিক্ষার বিধানই নবেলের মুখ্য উদ্দেশ্য হইবে এবং সেই উদ্দেশ্য সাধনে সফলতা
দেখিয়াই নবেলের উৎকর্ষ বিচার করিতে হইবে ।
ইঁহারাও বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতি সম্পূর্ণ প্রসন্ন নহেন।
ব্যাকরণশাস্ত্রে যেমন ভট্টিকাব্য[৬]
, ইহাদের মতে ধর্মনীতিশাস্ত্রে তেমনি নবেল, কাব্যের ছলনা করিয়া পাঠকগণকে কাঁদানোই নবেল রচনার মুখ্য উদ্দেশ্য। মানবসমাজের যথাযথ চিত্র আঁকিতে নৈপুণ্যের প্রয়োজন, আর নীতিশাস্ত্র অতি সাধু শাস্ত্র, ইহা
স্বীকার করিয়াও আমরা মনে করিয়া লইতে পারি – নবেল এক শ্রেণীর কাব্য এবং সৌন্দর্যসৃষ্টিই
কাব্যের প্রাণ। কেবল নীতিশাস্ত্র কেন, যদি কেহ দর্শনশাস্ত্র বা
রসায়নশাস্ত্রকেই নবেলের বিষয় করিতে চাহেন, তাহাতে আপত্তি করিব না। কিন্তু বিষয়টি যদি সুন্দর না হয়, তাহা হইলে তাহা কাব্য হয় না।
সৌন্দর্যের প্রকারভেদ আছে; গাছ-পালার ছবি সুন্দর হইতে পারে,
গুপ্ত হরিদাসও সুন্দর হইতে পারে, কিন্তু মানবজীবনের ও জগত-সংসারের গোড়ার কথাগুলি যিনি সুন্দর করিয়া দেখাইতে_পারেন, তিনিই প্রথম শ্রেণীর কবি। গোড়ার কথা দেখাইলেই কবি হয় না; সেটা দার্শনিকের ও বৈজ্ঞানিকের
ও ধর্মতত্ত্ববিদের কাজ, কিন্তু তাহা
সুন্দর করিয়া দেখাইতে পারিলেই কবি হয়। বঙ্কিমচন্দ্রের নবেলের মধ্যে সেই রকম
গোড়ার কথা দুই একটা সুন্দর করিয়া দেখানো হইয়াছে; এই জন্য আসনে তাঁহার স্থান অতি
উচ্চ ।
মানবজীবনের একটা গোড়ার কথ৷ এই যে, উহা আগাগোড়া
একটা সামঞ্জস্য স্থাপনের চেষ্টা মাত্র। শুধু মানবজীবনের কথাই
বা বলি কেন, বাহিঃপ্রকৃতির সহিত অন্তঃপ্রকৃতির নিরন্তর সামঞ্জস্য স্থাপনের
নামই জীবন। যাহারা হাবার্ট স্পেন্সার[৭]
প্রদত্ত জীবনের এই পারিভষিক সংজ্ঞা জানেন, তাহারা আমার কথায় সায় দিবেন। জীবনের উহা অপেক্ষা ব্যাপকতর সংজ্ঞা আম দেখি নাই। যাহার জীবন আছে, তাহাকে দুই দিকের টানাটানির মধ্যে বাস করিতে হয়। ধবলগিরি পর্বত বহু কাল হইতে বরফের বোঝা মাথায় করিয়া ভারতবর্ষের পুরুষপরম্পরা
অবলোকন করিতেছেন, কিন্তু বিজ্ঞানশাস্ত্র তাহার সজীবতায় সন্দেহ করেন। ধবলাগিরি এত মহান্
হইয়াও শীতাতপের ও জল-বৃষ্টির ও তুষারবৃষ্টির উৎপাত অকাতরে সহিয়া আসিতেছেন, এবং শত স্রোতাস্বনীর
সহস্র ধারা তাহার কলেবরকে শীর্ণ ও বিদীর্ণ ও ক্ষীণ করিয়া
তাহার অভ্রভেদী মস্তককে সমভূমি করিবার চেষ্টা করিতেছে - সেই আপন্নিবারণের জন্য তাহার কোন চেষ্টাই নাই । কিন্তু সামান্য একটি পিপীলিকা ক্রমাগত আহার সংগ্রহ কারয়া আপনার ক্ষয়শীল দেহের পূরণ
করিয়া থকে এবং যদি কেহ
তাহাকে দলিত করে, সে দংশন করিয়া
আত্মরক্ষণে সাধ্যমত ত্রুটি করে না। এক
দিকে বহিঃপ্রকৃতি তাহাকে ক্রমাগত ধ্বংসের মুখে টানিতেছে ;
অন্য দিকে সে ধ্বংস হইতে আত্মরক্ষার জন্য কেবলই চেষ্টা করিতেছে।
তাহার কীটজীবন এই চেষ্টার পরম্পরামাত্র। যে
দিন সেই চেষ্টার বিরাম, সেই দিন তাহার মৃত্যু । মানুষও ঠিক পিপীঁড়ার মতই জীবন ব্যাপিয়া আপনাকে মৃত্যুর কবল হইতে
রক্ষার জন্য ব্যাপৃত। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, কিন্তু
অন্তঃপ্রকৃতিকে বহিঃপ্রকৃতির আক্রমণ নিবারণে সমর্থ করিয়া
মৃত্যুনিবারণের ধারাবাহিক চেষ্টাই তাহার জীবন। সর্বনাশ সমুৎপন্ন হইলে পণ্ডিত লোক অর্ধ ত্যাগে বাধ্য হন;[৮] তাই মৃত্যু অনিবার্য জানিয়৷ পণ্ডিত-জীব আপনার অর্ধেককে অপত্যরূপে রাখিয়া অপরার্ধকে ত্যাগ করিয়া থাকেন। সর্বনাশ
সমুৎপন্ন হইলে জীবনের কিয়দংশ রক্ষার জন্য এই অপত্যোৎপাদন । আহার, নিদ্রা প্রভৃতি প্রবৃত্তির এক
মাত্র উদ্দেশ্য যেন তেন-প্রকারেণ জীবনরক্ষা। জীবনরক্ষার দুই উপায়, আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষা। পশুর সহিত নরের এই স্থলে
সামান্য প্রভেদ; কাজেই এ প্রবৃত্তিগুলিকে
আমরা পাশব প্রবৃত্তি বলিয়া থাকি।
কিন্তু মানুষের একটু বৈশিষ্ট্য আছে। মানুষ অতি দুর্বল পশু, সবল শত্রুর নিকট
আত্মরক্ষার জন্য সে আর একটা কৌশল আশ্রয় করিয়াছে। মানুষ দল বাঁধিয়া বাস করে; সেই দলের নাম সমাজ। দল বাঁধিয়া থাকিতে হইলে স্বাধীনতাকে ও স্বাতন্ত্র্যকে সংযত করিতে হয় – নতুবা দল ভাঙিয়া যায়। যে পাশব প্রবৃত্তি সমাজকে তুচ্ছ করিয়া মানুষকে
কেবল আত্মরক্ষার দিকে প্রেরিত করে, দলের
কল্যাণার্থ মানুষ সেই পাশব প্রবৃত্তির সংযমে বাধ্য হয়। সহজাত সংস্কারের অভাবে অতীতের অভিজ্ঞতায়
ভর দিয়া, ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি
রাখিয়া, বুদ্ধিপূর্বক পাশব প্রবৃত্তিকে সংযত করিতে হয়। এই জন্য যে বুদ্ধি আবশ্যক, তাহার নাম ধর্মবুদ্ধি; ইহা বিশিষ্টরূপে মানবধর্ম।
ইহা সমাজরক্ষার অনুকূল, ইহা লোকস্থিতির
সহায়। মানুষের পশুজীবনই ত দুই টানাটানির ব্যাপার; উহার উপর এই সমাজিক জীবন আর একটা নুতন টানাটানির সৃষ্টি করে; আত্মরক্ষার ও বংশরক্ষার অভিমুখে যে সকল প্রবৃত্তি, তাহা মানুষকে এক পথে প্রেরণ করে, আর মানুষের ধর্মুবুদ্ধি,
যাহা মুখ্যতঃ সমাজরক্ষার অর্থাৎ লোকস্থিতর অনুকূল, গৌণতঃ আত্মরক্ষার অনুকূল মাত্র, তাহা মানুষকে অন্য দিকে প্রেরণ করে। সামাজিক মানুষকে এই দুই টানাটানির মধ্যে পড়িয়া সামঞ্জস্য বিধানের জন্য কেবলই চেষ্টা করিতে হয়। এই
সামঞ্জস্য স্থাপনের নিরন্তর চেষ্টাই মানুষের নৈতিক জীবন। প্রবৃত্তি তাহাকে উদ্দাম স্বাতন্ত্র্যের দিকে ঠেলে, আর ধর্মবুদ্ধি তাহার অন্তরের অন্তর হইতে তাহাকে নিবৃত্তিমার্গে চালাইতে চেষ্টা করে। এই দুই টানাটানির মধ্যে পড়িয়া মনুষ্য কৃপার পাত্র। এইখানেই মনুষ্যের গোড়ায় গলদ;
Origin of sin[৯] এইখানেই অমঙ্গলের মূল; সংসার-বিষবৃক্ষের বীজ। Origin of evil ; মানবজীবনের
উৎকট রহস্যে ইহাই গোড়ার কথা । খোদার সঙ্গে শয়তানের চিরন্তন বিবাদের মূল এইখানে ।
মনুষ্যের হৃদয় সেই জীবনব্যাপী মহাহবের কুরুক্ষেত্র; - ধর্মের
সহিত অধর্মের মহাযুদ্ধ সেখানে নিরন্তর চলিতেছে । বঙ্কিমচন্দ্র
চারিখানি উপন্যাসে এই গোড়ার কথাটার আলোচনা করিয়াছেন। সেই মহাযুদ্ধের ক্ষেত্র হইয়া মানব-হৃদয়
কিরূপ ক্ষত-বিক্ষত ও রক্তাক্ত হইয়া থাকে, তাহা তিনি সুন্দর করিয়া দেখাইয়াছেন, তাহাতেই তিনি উচ্চশ্রেণীর কবি।
বিষবৃক্ষ, চন্দ্রশেখর, রজনী,
আর কৃষ্ণকান্তের উইল, এই চারিখানি উপন্যাসের
কথা আমি বলিতেছি। এই চারিখানি গ্রন্থের প্রতিপাদ্য বিষয় এক
। প্রতাপ ও নগেন্দ্র, অমরনাথ ও গোবিন্দলাল, সকলেই কুসুম শায়কের লক্ষ্য হইয়াছিলেন; ধর্মবুদ্ধির দৃঢ়তা ও প্রবৃত্তির তীব্রতার
তারতম্যানুসারে কেহ বা জয় লাভ করিয়াছিলেন, কেহ বা পারেন নাই। বীর্যবন্ত প্রতাপ সারা-জীবন
প্রবৃত্তির সহিত যুদ্ধ করিয়া সম্পূর্ণ জয়লাভ করিয়াছিলেন, তাহার
মৃত্যুর পূর্বে তাহার জীবনব্যাপী কঠোর ও নীরব সাধনার বিষয় জগতের লোক জানিতে
পারিয়াছিল । মোহমুগ্ধ অমরনাথ আপনার পিঠের উপর আকস্মিক পদস্খলনের স্থায়ী চিহ্ন ধারণ করিয়া তাহার স্বাভাবিক দম্ভের বলে পরবর্তী জীবনে সন্ন্যাসী সাজিয়া বেড়াইয়াছিলেন; পত্নীবৎসল নগেন্দ্রনাথ আপনার
আত্মাকে ছিন্ন ভিন্ন বিদীর্ণ করিয়া অনাথা পিতৃহীনা বালিকার প্রতি দয়াপ্রকাশের ফল
ভোগ করিয়াছিলেন; আর সর্বাপেক্ষা কৃপাপাত্র গোবিন্দলাল সর্বতোভাবে আপনার অনধীন ঘটনাচক্রের নিষ্ঠুর পেষণে নিষ্পিষ্ট হইয়া আপনাকে কলঙ্ক-হ্রদে নিমগ্ন করিয়া অবশেষে অপমৃত্যু-দ্বারা শান্তিলাভে
বাধ্য হইয়াছিলেন।
এই চারিটি মনুষ্যর বিভিন্ন দশার চিত্র সম্মুখে রাখিয়া আমরা কখনও মানবচরিত্রের মহিমা দেখিয়া স্পর্ধিত ও গর্বিত
হইতে পারি, কখনও বা জাগতিক শক্তির সম্মুখে
মানবের দৌর্বল্য দেখিয়া ভীত হইতে পারি। বঙ্কিমচন্দ্র মানবজীবনের ও জগদ্বিধানের এই সমস্যা –
এই গোড়ার কথা অতি সুন্দর চিত্রে চিত্রিত
করিয়াছেন এবং এই জন্য তিনি উচ্চশ্রেণীর কবি।
(১৩১২ সালের ২৬শে চৈত্র ক্ল্যাসিক থিয়েটারে সত্যেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সভাপতিত্বে আহূত স্মৃতি-সভায় বঙ্কিমচন্দ্র সম্বন্ধে নিবন্ধটি লেখক কর্তৃক পঠিত হয়।)
(ক্রমশঃ ... তৃতীয় পর্ব দেখুন)
চরিতকথা - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রচিত প্রবন্ধ 'বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' থেকে প্রশ্নোত্তর ও নোটসের আলোচনার জন্যে আমাদের ইউটিউব চ্যানেল দেখুন।
0 মন্তব্যসমূহ