ছিন্নপত্র-১০২
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পতিসর,
২৮শে মার্চ, ১৮৯৪।
এদিকে গরমটাও বেশ পড়েছে - কিন্তু রৌদ্রের উত্তাপটাকে আমি বড় একটা
গ্রাহ্য করিনে। তপ্ত বাতাস ধুলোবালি খড়কুটো উড়িয়ে নিয়ে হুহু শব্দ করে ছুটেছে –
প্রায়ই হঠাৎ এক এক জায়গায় একটা আজগবি ঘূর্ণিবাতাস দাঁড়িয়ে উঠে শুকনো পাতা এবং
ধূলোর ওড়না ঘুরিয়ে ঘুরতে ঘুরতে নেচে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে - সেটা দেখতে বেশ লাগে।
নদীর ধারে বাগান থেকে পাখিগুলো ভারী মিষ্টি ডাকচে - মনে হচ্চে ঠিক বসন্তই বটে, তপ্ত
খোলা থেকে একেবারে গরম গরম নাবিয়ে এনেছে – কিন্তু গরমটা পরিমাণে কিঞ্চিৎ বেশি, আর
একটুখানি জুড়িয়ে আনলে বিশেষ ক্ষতি ছিল না। আজ সকাল বেলাটায় হঠাৎ দিব্যি ঠান্ডা
পড়েছিল – এমন কি প্রায় শীতকালেরই মত স্নান - করবার সময় মনে খুব প্রবল উৎসাহ ছিল
না। এই প্রকৃতি নামক একটা বৃহৎ ব্যাপারের মধ্যে কখন যে কি হচ্চে তার হিসেব পাওয়া
শক্ত - কোথায় তার কোন অজ্ঞাত কোণে কি একটা কান্ড ঘটচে আর অকস্মাৎ চারদিকের সমস্ত
ভাবখানা বদলে যাচ্চে। আমি কাল ভাবছিলুম মানুষের মনখানাও ঠিক ঐ প্রকান্ড প্রকৃতির
মতো রহস্যময়। চতুর্দিকে শিরা-উপশিরা স্নায়ু মস্তিষ্ক মজ্জার ভিতর কি এক অবিশ্রাম
ইন্দ্রজাল চলচে - হুহু শব্দে রক্তস্রোত
ছুটছে স্নায়ুগুলো কাঁপচে হৃদপিণ্ড উঠচে পড়চে, আর এই রহস্যময়ী মানবপ্রকৃতির
মধ্যে ঋতু পরিবর্তন হচ্চে। কোথা থেকে কখন কি হাওয়া আসে আমরা কিছুই জানিনে। আজ মনে
করলুম জীবনটা দিব্যি চালাতে পারব, বেশ বল আছে, সংসারের দুঃখযন্ত্রণাগুলোকে একেবারে
ডিঙিয়ে চলে যাব, এই ভেবে সমস্ত জীবনের প্রোগ্রামটি ছাপিয়ে এনে শক্ত করে বাঁধিয়ে
পকেটে রেখে নিশ্চিন্ত আছি; কাল দেখি কোন অজ্ঞাত রসাতল থেকে আর
একটা হাওয়া দিয়েছে, আকাশের ভাবগতিক সমস্ত বদলে গেছে, তখন আর
মনে হয় না এ দুর্যোগ কোনোকালে কাটিয়ে উঠতে পারব। এসবের উৎপত্তি কোনখানে? কোন
শিরার মধ্যে স্নায়ুর মধ্যে কি একটা নড়চড় হয়ে গেছে মাঝের থেকে আমি আমার সমস্ত
বলবুদ্ধি নিয়ে আর কুলিয়ে উঠতে পারিনে। নিজের ভিতরকার এই অপার রহস্যের কথা মনে
করলে ভারি ভয় হয় - কি করতে পারব না পারব কিছুই জোর করে বলতে পারিনে - মনে হয়,
কিছুই না জেনে আমি এ কি একটা প্রকাণ্ড কান্ড সর্বদা স্কন্ধে বহন করে নিয়ে বেড়াই,
আয়ত্ত করতে পারিনে অথচ এর হাতও কিছুতেই এড়াতে পারিনে - জানিনে আমাকে কোথায় নিয়ে যাবে আমিই বা একে কোথায় নিয়ে
যাব - আমার স্কন্ধে এই ভয়ঙ্কর রহস্য যোজনা করে দেবার কি প্রয়োজন ছিল? বুকের ভিতর
কি হয়, শিরার মধ্যে কি চলচে, মস্তিষ্কের মধ্যে কি নড়চে, কত কি অসংখ্য কান্ড আমাকে
অবিশ্রাম আচ্ছন্ন করে ঘটচে, আমি দেখতে পাচ্চিনে, আমার সঙ্গে পরামর্শও করে না, অথচ সবশুদ্ধ
নিয়ে খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে কর্তাব্যক্তির মত মুখ করে মনে করচি আমি একজন আমি! তুমিত
ভারি তুমি- তোমার নিজের কতটুকুই বা জান তার ঠিক নেই। আমিত অনেক ভেবেচিন্তে এই টুকু
ঠিক করেছি আমি নিজেকে কিছুই জানিনে। আমি একটা সজীব পিয়ানো যন্ত্রের মত - ভিতরে
অন্ধকারের মধ্যে অনেকগুলো তার এবং কলবল আছে - কখন কে এসে বাজায় কিছুই জানিনে -
কেন বাজে তাও সম্পূর্ণ বোঝা শক্ত- কি বাজে সেইটেই জানি - সুখ বাজে কি ব্যথা বাজে, কড়ি
বাজে কি কোমল বাজে, তালে বাজে কি বেতালে বাজে এইটুকুই বুঝতে পারি। আর জানি আমার অক্টেভ
নিচের দিকেই বা কতদূর উপরের দিকেই বা কতদূর। না – তাও কি ঠিক জানি?
0 মন্তব্যসমূহ