বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ
ও অনন্যসাধারণ প্রতিভার অধিকারী বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি ১৯৮৪ খ্রিস্টাব্দের
১২ সেপ্টেম্বর নদীয়া জেলার কাঁচড়াপাড়ার কাছে ঘোষপুর মুরাতিপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
তাঁর পিতার নাম মহানন্দ এবং মাতার নাম মৃণালিনী দেবী। লেখকের পৈতৃক বাসস্থান ছিল ২৪
পরগণা জেলার বনগাঁ মহকুমার অন্তর্গত ব্যারাকপুর গ্রামে। অসামান্য প্রতিভার অধিকারী
ও জনপ্রিয় ভারতীয় বাঙালি কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণের সর্বশ্রেষ্ঠ উপন্যাস পথের পাঁচালী।
১৯২৯-এ তিনি এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। ‘বিচিত্রা’ পত্রিকাতে এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত
হয়েছিল। এই উপন্যাস প্রসঙ্গে ড শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, “ইহার মৌলিকতা ও সরস
নবীনতা বঙ্গ-উপন্যাসের গতানুগতিশীলতার মধ্যে একটি পরম বিস্ময়াবহ আবির্ভাব। অপুর ন্যায় জীবন্ত ও পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে
চিত্রিত চরিত্র বাংলা উপন্যাস-সাহিত্যে আর দ্বিতীয় নাই।” এই উপন্যাস অবলম্বনে সত্যজিৎ
রায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন যা আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেছে। ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস
মোট তিনটি খণ্ডে বিভক্ত। যথা – (১) বল্লালী বালাই, (২) আম আঁটির ভেঁপু, এবং (৩) অক্রূর
সংবাদ।
পথের পাঁচালী
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়
বল্লালী বালাই
প্রথম পরিচ্ছেদ
নিশ্চিন্দিপুর গ্রামের একেবারে
উত্তরপ্রান্তে হরিহর রায়ের ক্ষুদ্র কোঠাবাড়ী। হরিহর সাধারণ অবস্থার গৃহস্থ,
পৈতৃক আমলের সামান্য জমিজমার আয় ও দু-চার ঘর শিষ্য সেবকের বার্ষিকী প্রণামীর
বন্দোবস্ত হইতে সাদাসিধাভাবে সংসার চালাইয়া থাকে।
পূর্বদিন ছিল একাদশী। হরিহরের
দূরসম্পর্কীয় দিদি ইন্দির ঠাক্রুণ সকালবেলা ঘরের দাওয়ায় বসিয়া চালভাজার
গুঁড়া জলখাবার খাইতেছে। হরিহরের ছয় বৎসরের মেয়েটি চুপ করিয়া পাশে বসিয়া আছে ও
পাত্র হইতে তুলিবার পর হইতে মুখে পুরিবার পূর্ব পর্যন্ত প্রতিমুঠা ভাজার গুঁড়ার
গতি অত্যন্ত করুণভাবে লক্ষ্য করিতেছে এবং মাঝে মাঝে ক্রমশূন্যায়মান কাঁসার
জামবাটির দিকে হতাশভাবে চাহিতেছে। দু-একবার কি বলি বলি করিয়াও যেন বলিতে পারিল
না। ইন্দির ঠাক্রুণ মুঠার পর মুঠা উঠাইয়া পাত্র নিঃশেষ করিয়া ফেলিয়া খুকীর
দিকে চাহিয়া বলিল, ও মা, তোর জন্যে দুটো রেখে দেলাম না? — ওই দ্যাখো!
মেয়েটি করুণ চোখে বলিল, তা হোক পিতি, তুই খা —
দুটো পাকা বড় বীচে-কলার একটা হইতে আধখানা ভাঙ্গিয়া
ইন্দির ঠাক্রুণ তাহার হাতে দিল। এবার খুকীর চোখ-মুখ উজ্জ্বল দেখাইল—সে পিসিমার
হাত হইতে উপহার লইয়া মনোযোগের সহিত ধীরে ধীরে চুষিতে লাগিল।
ও ঘর হইতে তাহার মা ডাকিল, আবার ওখানে গিয়া ধন্না দিয়ে
বসে আছে? উঠে আয় ইদিকে!
ইন্দির ঠাক্রুণ বলিল, থাক বৌ — আমার কাছে বসে আছে, ও
কিছু করচে না। থাক্ বসে—
তবুও তাহার মা শাসনের সুরে বলিল, না। কেনই বা খাবার সময়
ওরকম বসে থাকবে? ওসব আমি পছন্দ করি নে; চলে আয় বল্চি উঠে—
খুকী ভয়ে ভয়ে উঠিয়া গেল।
ইন্দির ঠাক্রুণের সঙ্গে হরিহরের
সম্পর্কটা বড় দূরের। মামার বাড়ীর সম্পর্কে কি রকমের বোন। হরিহর রায়ের
পূর্বপুরুষের আদি বাড়ী ছিল পাশের গ্রামে যশড়া-বিষ্ণুপুর। হরিহরের পিতা রামচাঁদ
রায় মহাশয় অল্প-বয়সে প্রথমবার বিপত্নীক হইবার পরে অত্যন্ত ক্ষোভের সহিত লক্ষ্য
করিলেন যে দ্বিতীয়বার তাঁহার বিবাহ দিবার দিকে পিতৃদেবের কোন লক্ষ্যই নাই।
বছরখানেক কোনরকমে চক্ষুলজ্জায় কাটাইয়া দেওয়ার পরও যখন পিতার সেদিকে কোন উদ্যম
দেখা গেল না, তখন রামচাঁদ মরীয়া হইয়া প্রত্যক্ষে ও পরোক্ষে নানারূপ অস্ত্র
ব্যবহার করিতে বাধ্য হইলেন। দুপুরবেলা কোথাও কিছু নাই, সহজ মানুষ রামচাঁদ আহারাদি
করিয়া বিছানায় ছটফট করিতেছেন — কেহ নিকটে বসিয়া কি হইয়াছে জানিতে চাহিলে
রামচাঁদ সুর ধরিতেন, তাঁহার আর কে আছে, কে-ই বা আর তাঁহাকে দেখিবে—এখন তাঁহার মাথা
ধরিলেই বা কি—ইত্যাদি। ফলে এই নিশ্চিন্দিপুর গ্রামে রামচাঁদের দ্বিতীয় পক্ষের
বিবাহ হয়, এবং বিবাহের অল্পদিন পরে পিতৃদেবের মৃত্যু হইলে যশড়া-বিষ্ণুপুরের বাস
উঠাইয়া রামচাঁদ স্থায়ীভাবে এখানেই বসবাস শুরু করেন। ইহা তাঁহার অল্প বয়সের
কথা—রামচাঁদ এ গ্রামে আসিবার পর শ্বশুরের যত্নে টোলে সংস্কৃত পড়িতে আরম্ভ করেন,
এবং কালে এ অঞ্চলের মধ্যে ভাল পণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছিলেন। তবে কোন বিষয়কর্ম কোনদিন
তিনি করেন নাই, করার উপযুক্ত তিনি ছিলেন কিনা, সে বিষয়েও ঘোরতর সন্দেহের কারণ
আছে। বৎসরের মধ্যে নয় মাস তাঁহার স্ত্রী-পুত্র শ্বশুরবাড়িতেই থাকিত। তিনি নিজে
পাড়ার পতিরাম মুখুয্যের পাশার আড্ডায় অধিকাংশ সময় কাটাইয়া দুইবেলা ভোজনের সময়
শ্বশুরবাড়ী হাজির হইতেন মাত্র; যদি কেহ জিজ্ঞাসা করিত—পণ্ডিতমশায়, বৌটা ছেলেটা
আছে, আখেরটা তো দেখতে হবে? রামচাঁদ বলিতেন—কোন ভাবনা নেই ভায়া, ব্রজো চক্কোত্তির
ধানের মরাই-এর তলা কুড়িয়ে খেলেও এখন ওদের দু-পুরুষ হেসে-খেলে কাটবে। পরে তিনি
ছক্কা ও পঞ্জুড়ির জোড় কি ভাবে মিলাইলে ঘর ভাঙিতে পারিবেন, তাহাই একমনে ভাবিতেন।
ব্রজ চক্রবর্তীর ধানের মরাই-এর
নিত্যতা সম্বন্ধে তাঁহার আস্থা যে কতটা বে-আন্দাজী ধরনের হইয়াছিল, তাহা শ্বশুরের
মৃত্যুর পরে রামচাঁদের বুঝিতে বেশি বিলম্ব হয় নাই। এ গ্রামে তাঁহার জমিজমাও ছিল
না, নগদ টাকাও বিশেষ কিছু নয়। দুই চারিটি শিষ্য-সেবক এদিকে ওদিকে জুটিয়াছিল,
তাহাদের দ্বারা কোন রকমে সংসার চালাইয়া পুত্রটিকে মানুষ করিতে থাকেন। তাঁহার পূর্বে
তাঁহার এক জ্ঞাতি-ভ্রাতার বিবাহ তাঁহার শ্বশুরবাড়ীতেই হয়। তাহারাও এখানেই বাস
করিয়াছিল। তাহাদের দ্বারাও রামচাঁদের অনেক সাহায্য হইত। জ্ঞাতি-ভ্রাতার পুত্র
নীলমণি রায় কমিসেরিয়েটে চাকরি করিতেন, কিন্তু কর্ম উপলক্ষে তাঁহাকে বরাবর বিদেশে
থাকিতে হইত বলিয়া তিনি শেষকালে এখানকার বাস একরূপ উঠাইয়া বৃদ্ধা মাতাকে লইয়া
কর্মস্থলে চলিয়া যান। এখন তাঁহাদের ভিটাতে আর কেহ নাই।
শোনা যায়, পূর্বদেশীয় এক নামজাদা
কুলীনের সঙ্গে ইন্দির ঠাক্রুণের বিবাহ হইয়াছিল। স্বামী বিবাহের পর কালেভদ্রে এ
গ্রামে পদার্পণ করিতেন। এক-আধ রাত্রি কাটাইয়া পথের খরচ ও কৌলীন্য সম্মান আদায়
করিয়া লইয়া, খাতায় দাগ আঁকিয়া পরবর্তী নম্বরের শ্বশুরবাড়ী অভিমুখে তল্পী-বাহক
সহ রওনা হইতেন, কাজেই স্বামীকে ইন্দির ঠাক্রুণ ভাল মনে করিতেই পারে না।
বাপ-মায়ের মৃত্যুর পর ভাই-এর আশ্রয়ে দু-মুঠা অন্ন পাইয়া আসিতেছিল, কপালক্রমে সে
ভাইও অল্প বয়সে মারা গেল। হরিহরের পিতা রামচাঁদ অল্প পরেই এ ভিটাতে বাড়ী তুলিলেন
এবং সেই সময় হইতেই ইন্দির ঠাক্রুণের এ সংসারে প্রথম প্রবেশ। সে সকল আজিকার কথা
নহে।
তাহার পর অনেকদিন হইয়া গিয়াছে;
শাঁখারীপুকুরে নাল ফুলের বংশের পর বংশ কত আসিয়াছে, চলিয়া গিয়াছে। চক্রবর্তীদের
ফাঁকা মাঠে সীতানাথ মুখুয্যে নতুন কলমের বাগান বসাইল এবং সে সব গাছ আবার বুড়া
হইতেও চলিল। কত ভিটায় নতুন গৃহস্থ বসিল। কত জনশূন্য হইয়া গেল, কত গোলোক
চক্রবর্তী, ব্রজ চক্রবর্তী মরিয়া হাজিয়া গেল, ইছামতীর চলোর্মি-চঞ্চল স্বচ্ছ
জলধারা অনন্ত কালপ্রবাহের সঙ্গে পাল্লা দিয়া কুটার মত, ঢেউয়ের ফেনার মত, গ্রামের
নীলকুঠির কত জন্সন টম্সন সাহেব, কত মজুরদারকে কোথায় ভাসাইয়া লইয়া গেল!
শুধু ইন্দির ঠাক্রুণ এখনও বাঁচিয়া আছে। ১২৪০ সালের সে
ছিপ্ছিপে চেহারার হাস্যমুখী তরুণী নহে, পঁচাত্তর বৎসরের বৃদ্ধা, গাল তোব্ড়াইয়া
গিয়াছে, মাজা ঈষৎ ভাঙিয়া শরীর সামনে ঝুঁকিয়া পড়িয়াছে, দূরের জিনিস আগের মত
চোখে ঠাহর হয় না, হাত তুলিয়া যেন রৌদ্রের ঝাঁজ হইতে বাঁচাইবার ভঙ্গিতে চোখ
ঢাকিয়া বলে, কে আসে? নবীন? বেহারী? না, ও, তুমি রাজু . . . .
এই ভিটারই কি কম পরিবর্তনটা ইন্দির
ঠাক্রুণের চোখের উপর ঘটিয়া গেল! ঐ ব্রজ চক্রবর্তীর যে ভিটা আজকাল জঙ্গল হইয়া
পড়িয়া আছে, কোজাগরী লক্ষ্মী-পূর্ণিমার দিন গ্রামসুদ্ধ লোক সেখানে পাত পাড়িত।
বড় চণ্ডীমণ্ডপে কি পাশার আড্ডাটাই বসিত সকালে বিকালে! তখন কি ছিল ঐ রকম বাঁশবন!
পৌষ-পার্বণের দিন ঐ ঢেঁকিশালে একমণ চাল কোটা হইত পৌষ-পিঠার জন্য—চোখ বুজিয়া
ভাবিলেই ইন্দির ঠাক্রুণ সে সব এখনও দেখিতে পায় যে! ঐ রায় বাড়ীর মেজবৌ লোকজন
সঙ্গে করিয়া চাল কুটাইতে আসিয়াছেন, ঢেঁকিতে দমাদম পাড় পড়িতেছে, সোনার বাউটি
রাঙা হাতে একবার সামনে সরিয়া আসিতেছে আবার পিছাইয়া যাইতেছে, জগদ্ধাত্রীর মত রূপ,
তেমনি স্বভাবচরিত্র। নতুন যখন ইন্দির ঠাক্রুণ বিধবা হইল, তখন প্রতি দ্বাদশীর দিন
প্রাতঃকালে নিজের হাতে জলখাবার গোছাইয়া আনিয়া তাহাকে খাওয়াইয়া যাইতেন। কোথায়
গেল কে! সেকালের আর কেহ বাঁচিয়া নাই যার সঙ্গে সুখদুঃখের দুটো কথা কয়।
তারপর ঐ সংসারে আশ্রয়দাতা রামচাঁদ
মারা গেলেন, তাঁর ছেলে হরিহর তো হইল সেদিন। ঘাটের পথে লাফাইয়া লাফাইয়া খেলিয়া
বেড়াইত, মুখুয্যেদের তেঁতুল গাছে ডাঁশা তেঁতুল খাইতে গিয়া পড়িয়া হাত ভাঙিয়া
দুই-তিন মাস শয্যাগত ছিল; সেদিনের কথা। ধূমধাম করিয়া অল্প বয়সে তাহার বিবাহ হইল—
পিতার মৃত্যুর পর দশ বৎসরের নববিবাহিতা পত্নীকে বাপের বাড়ী ফেলিয়া রাখিয়া
দেশছাড়া হইয়া গেল। আট দশ বছর প্রায় কোন খোঁজখবর ছিল না—কালেভদ্রে এক-আধখানা
চিঠি দিত, কখনো কখনো দু’পাঁচ টাকা বুড়ীর নামে মনি অর্ডার করিয়া পাঠাইত। এই বাড়ী
আগুলিয়া কত কষ্টে, কতদিন না খাইয়া প্রতিবেশীর দুয়ারে চাহিয়া চিন্তিয়া তাহার
দিন গিয়াছে।
অনেকদিন পরে হরিহর আজ ছয় সাত বৎসর
আসিয়া ঘর-সংসার পাতিয়াছে, তাহার একটি মেয়ে হইয়াছে— সেও প্রায় ছয় বৎসরেরটি
হইতে চলিল। বুড়ী ভাবিয়াছিল এতদিনে সেই ছেলেবেলার ঘর-সংসার আবার বজায় হইল। তাহার
সঙ্কীর্ণ জীবনে সে অন্য সুখ চাহে নাই, অন্য প্রকার সুখ-দুঃখের ধারণাও সে করিতে
অক্ষম — আশৈশব-অভ্যস্ত জীবনযাত্রার পুরাতন পথে যদি গতির মোড়টা ঘুরিয়া দাঁড়ায়
তাহা হইলেই সে খুশী, তাহার কাছে সেইটাই চরম সুখের কাহিনী।
হরিহরের ছোট্ট মেয়েটাকে সে একদণ্ড
চোখের আড়াল করিতে পারে না — তাহার নিজেরও এক মেয়ে ছিল, নাম ছিল তার বিশ্বেশ্বরী।
অল্প বয়সেই বিবাহ হয় এবং বিবাহের অল্প পরেই মারা যায়। হরিহরের মেয়ের মধ্যে
বিশ্বেশ্বরী মৃত্যুপারের দেশ হইতে চল্লিশ বছর পরে তাহার অনাথা মায়ের কোলে আবার
ফিরিয়া আসিয়াছে। চল্লিশ বছরের নিভিয়া-যাওয়া ঘুমন্ত মাতৃত্ব মেয়েটার মুখের
বিপন্ন অপ্রতিভ ভঙ্গিতে, অবোধ চোখের হাসিতে—একমুহূর্তে সচকিত আগ্রহে, শেষ-হইতে চলা
জীবনের ব্যাকুল ক্ষুধায় জাগিয়া উঠে।
কিন্তু যাহা সে ভাবিয়াছিল তাহা
হয় নাই। হরিহরের বৌ দেখিতে টুকটুকে সুন্দরী হইলে কি হইবে, ভারী ঝগড়াটে, তাহাকে
তো দুই চক্ষু পাড়িয়া দেখিতে পারে না। কোথাকার কে তার ঠিকানা নাই, কি তাহার সঙ্গে
সম্পর্ক খুঁজিয়া মেলে না, বসিয়া বসিয়া অন্নধ্বংস করিতেছে!
সে খুঁটিনাটি লইয়া বুড়ীর সঙ্গে
দু’বেলায় ঝগড়া বাধায়। অনেকটা ঝগড়া চলিবার পর বুড়ী নিজস্ব একটি পিতলের ঘটী
কাঁখে ও ডান হাতে একটা কাপড়ের পটুলি ঝুলাইয়া বলিত—চল্লাম নতুন বৌ, আর যদি কখনো ও
বাড়ীর মাটি মাড়াই, তবে আমার—। বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গিয়া বুড়ী মনের দুঃখে
বাঁশবাগানে সারাদিন বসিয়া কাটাইত। বৈকালের দিকে সন্ধান পাইয়া হরিহরের ছোট
মেয়েটা তাহার কাছে গিয়া তাহার আঁচল ধরিয়া টানাটানি আরম্ভ করিত— ওঠ্ পিতিমা,
মাকে বল্বো আল্ তোকে বক্বে না, আয় পিতিমা। তাহার হাত ধরিয়া সন্ধ্যার অন্ধকারে
বুড়ী বাড়ী ফিরিত। সর্বজয়া মুখ ফিরাইয়া বলিত, ঐ এলেন! যাবেন আর কোথায়। যাবার
কি আর চুলো আছে এই ছাড়া? . . . তেজটুকু আছে এদিকে ষোল আনা!
এ রকম উহারা বাড়ী আসার
বৎসর-খানেকের মধ্যেই আরম্ভ হইয়াছে—বহুবার হইয়া গিয়াছে এবং মাঝে মাঝে প্রায়ই
হয়।
হরিহরের পূর্বের ভিটায় খড়ের
ঘরখানা অনেকদিন বে-মেরামতি অবস্থায় পড়িয়া আছে। এই ঘরটাতেই বুড়ী থাকে। একটা
বাঁশের আলনায় খান দুই ময়লা ছেঁড়া থান ছেঁড়া জায়গাটার দুই প্রান্ত একসঙ্গে
করিয়া গেরো বাঁধা। বুড়ী আজকাল ছুঁচে সুতা পরাইতে পারে না বলিয়া কাপড় সেলাই
করিবার সুবিধা নাই, বেশি ছিঁড়িয়া গেলে গেরো বাঁধে। একপাশে একখানা ছেঁড়া মাদুর ও
কতকগুলি ছেঁড়া কাঁথা। একটা পুঁট্লিতে রাজ্যের ছেঁড়া কাপড় বাঁধা। মনে হয় কাঁথা
বুনিবার উপকরণ স্বরূপ সেগুলি বহুদিন হইতে সযত্নে সঞ্চিত আছে, কখনও দরকার হয় নাই,
বর্তমানে দরকার হইলেও কাঁথা বুনিবার মত চোখের তেজ আর তাহার নাই। তবুও সেগুলি পরম
যত্নে তোলা থাকে, ভাদ্রমাসে বর্ষার পর রৌদ্র ফুটিলে বুড়ী সেগুলি খুলিয়া মাঝে
মাঝে উঠানে রৌদ্রে দেয়। বেতের পেট্রাটার মধ্যে একটা পঁটুলি বাঁধা কতকগুলো ছেঁড়া
লালপাড় শাড়ী—সেগুলি তাহার মেয়ে বিশ্বেশ্বরীর; একটা পিতলের চাদরের ঘটী, একটা
মাটির ছোবা, গোটা দুই মাটির ভাঁড়। পিতলের ঘটীতে চালভাজা ভরা থাকে, রাত্রে
হামানদিস্তা দিয়া গুঁড়া করিয়া তাই মাঝে মাঝে খায়। মাটির ভাঁড়গুলার কোনটাতে
একটুখানি তেল, কোনটাতে একটু নুন, কোনটাতে সামান্য একটু খেজুরের গুড়। সর্বজয়ার
কাছে চাহিলে সব সময় মেলে না বলিয়া বুড়ী সংসার হইতে লুকাইয়া আনিয়া সেগুলি
বিবাহের বেতের পেঁট্রার মধ্যে সঞ্চয় করিয়া রাখিয়া দেয়।
সর্বজয়া এ ঘরে আসে ক্বচিৎ
কালেভদ্রে কখনো। কিন্তু সন্ধ্যার সময় তার মেয়ে ঘরের দাওয়ায় ছেঁড়া-কাঁথা-পাতা
বিছানায় বসিয়া অনেকক্ষণ পর্যন্ত একমনে পিসিমার মুখে রূপকথা শোনে। খানিকক্ষণ এ
গল্প ও গল্প শুনিবার পর খুকী বলে,—পিতি, সেই ডাকাতের গল্পটা বল্ তো! গ্রামের একঘর
গৃহস্থবাড়ীতে পঞ্চাশ বছর আগে ডাকাতি হইয়াছিল, সেই গল্প। ইতিপূর্বে বহুবার বলা
হইয়া গেলেও কয়েকদিনের ব্যবধানে উহার পুনরাবৃত্তি করিতে হয়, খুকী ছাড়ে না।
তাহার পর সে পিসিমার মুখে ছড়া শোনে। সেকালের অনেক ছড়া ইন্দির ঠাক্রুণের মুখস্থ
ছিল। অল্পবয়সে ঘাটে পথে সমবয়সী সঙ্গিনীদের কাছে ছড়া মুখস্থ বলিয়া তখনকার দিনে
ইন্দির ঠাক্রুণ কত প্রশংসা আদায় করিয়াছে। তাহার পর অনেক দিন সে এরকম ধৈর্যশীল
শ্রোতা পায় নাই; পাছে মরিচা পড়িয়া যায়, এইজন্য তাহার জানা সব ছড়াগুলিই আজকাল
প্রতি সন্ধ্যায় একবার ক্ষুদ্র ভাইঝিটির কাছে আবৃত্তি করিয়া ধার শানাইয়া রাখে।
টানিয়া টানিয়া আবৃত্তি করে —
ও ললিতে চাঁপকলিতে একটা কথা শুনসে,
রাধার ঘরে চোর ঢুকেছে—
এই পর্যন্ত বলিয়া সে হাসি-হাসি মুখে প্রতীক্ষার
দৃষ্টিতে ভাইঝির দিকে চাহিয়া থাকে। খুকী উৎসাহের সঙ্গে বলে—চূড়োবাঁধা এক-মিন্সে।—
‘মি’ অক্ষরটার উপর অকারণ জোর দিয়া ছোট মাথাটি সামনে তাল রাখিবার ভাবে ঝুঁকাইয়া
পদটার উচ্চারণ শেষ করে। ভারি আমোদ লাগে খুকীর।
তাহার পিসি ভাইঝিকে ঠকাইবার
চেষ্টায় এমন সব ছড়া আবৃত্তি করে ও পদপূরণের জন্য ছাড়িয়া দেয়, যাহা হয়তো দশ
পনেরো দিন বলা হয় নাই—কিন্তু খুকী ঠিক মনে রাখে, তাহাকে ঠকানো কঠিন।
খানিক রাত্রে তাহার মা খাইতে
ডাকিলে সে উঠিয়া যায়।
0 মন্তব্যসমূহ