মুক্তধারা (পাঠ পর্ব-২) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
উত্তরকূটের যুবরাজ অভিজিৎ যন্ত্ররাজ বিভূতির
নিকট দূত পাঠাইয়াছেন। বিভূতি যখন মন্দিরের দিকে চলিয়াছে তখন দূতের সহিত তাহার সাক্ষাৎ
দূত। যন্ত্ররাজ বিভূতি, যুবরাজ আমাকে পাঠিয়ে দিলে
বিভূতি। কী তাঁর আদেশ?
দূত। এতকাল ধরে তুমি আমাদের মুক্তধারার ঝরনাকে বাঁধ দিয়ে বাঁধতে
লেগেছ। বার বার ভেঙে গেল, কত লোক ধুলোবালি চাপা পড়ল, কত লোক বন্যায় ভেসে গেল। আজ শেষে—
বিভূতি। তাদের প্রাণ দেওয়া ব্যর্থ হয় নি। আমার বাঁধ সর্ম্পূণ
হয়েছে।
দূত। শিবতরাইয়ের প্রজারা এখন এ খবর জানে
না। তারা বিশ্বাস করতেই পারে না যে, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন কোনো মানুষ তা বন্ধ
করতে পারে।
বিভূতি। দেবতা তাদের কেবল জলই দিয়েছেন, আমাকে দিয়েছেন জলকে
বাঁধবার শক্তি।
দূত। তারা নিশ্চিন্ত আছে, জানে না আর সপ্তাহ পরেই তাদের চাষের
খেত—
বিভূতি। চাষের খেতের কথা কী বলছ?
দূত। সেই খেত শুকিয়ে মারাই কি তোমার বাঁধ বাঁধার উদ্দেশ্য ছিল
না?
বিভূতি। বালি-পাথর-জলের ষড়যন্ত্র ভেদ করে মানুষের বুদ্ধি হবে
জয়ী এই ছিল উদ্দেশ্য। কোন্ চাষির কোন্ ভুট্টার খেত মারা যাবে সে-কথা ভাববার সময় ছিল
না।
দূত। যুবরাজ জিজ্ঞাসা করছেন এখনো কি ভাববার সময় হয় নি?
বিভূতি। না, আমি যন্ত্রশক্তির মহিমার কথা ভাবছি।
দূত। ক্ষুধিতের কান্না তোমার সে ভাবনা ভাঙাতে পারবে না?
বিভূতি। না। জলের বেগে আমার বাঁধ ভাঙে না, কান্নার জোরে আমার
যন্ত্র টলে না।
দূত। অভিশাপের ভয় নেই তোমার?
বিভূতি। অভিশাপ! দেখো, উত্তরকূটে যখন মজুর পাওয়া যাচ্ছিল না
তখন রাজার আদেশে চণ্ডপত্তনের প্রত্যেক ঘর থেকে আঠারো বছরের উপর বয়সের ছেলেকে আমরা আনিয়ে
নিয়েছি। তারা তো অনেকেই ফেরে নি। সেখানকার কত মায়ের অভিশাপের উপর আমার যন্ত্র জয়ী হয়েছে।
দৈবশক্তির সঙ্গে যার লড়াই, মানুষের অভিশাপকে সে গ্রাহ্য করে?
দূত। যুবরাজ বলছেন কীর্তি গড়ে তোলবার গৌরব তো লাভ হয়েছেই, এখন
কীর্তি নিজে ভাঙবার যে আরো বড়ো গৌরব তাই লাভ করো।
বিভূতি। কীর্তি যখন গড়া শেষ হয় নি তখন সে আমার ছিল; এখন সে
উত্তরকূটের সকলের। ভাঙবার অধিকার আর আমার নেই।
দূত। যুবরাজ বলছেন ভাঙবার অধিকার তিনিই গ্রহণ করবেন।
বিভূতি। স্বয়ং উত্তরকূটের যুবরাজ এমন কথা বলেন? তিনি কি আমাদেরই
নন? তিনি কি শিবতরাইয়ের?
দূত। তিনি বলেন— উত্তরকূটে কেবল যন্ত্রের রাজত্ব নয়, সেখানে
দেবতাও আছেন, এই কথা প্রমাণ করা চাই।
বিভূতি। যন্ত্রের জোরে দেবতার পদ নিজেই নেব এই কথা প্রমাণ করবার
ভার আমার উপর। যুবরাজকে বোলো আমার এই বাঁধযন্ত্রের মুঠো একটুও আলগা করতে পারা যায় এমন
পথ খোলা রাখি নি।
দূত। ভাঙনের যিনি দেবতা তিনি সব সময় বড়ো পথ দিয়ে চলাচল করেন
না। তাঁর জন্যে যে-সব ছিদ্রপথ থাকে সে কারও চোখে পড়ে না।
বিভূতি। (চমকিয়া) ছিদ্র? সে আবার কী? ছিদ্রের কথা তুমি কী জান?
দূত। আমি কি জানি? যাঁর জানবার দরকার তিনি জেনে নেবেন।
[ দূতের প্রস্থান
উত্তরকূটের নাগরিকগণ উৎসব করিতে মন্দিরে
চলিয়াছে। বিভূতিকে দেখিয়া
১। বাঃ যন্ত্ররাজ, তুমি তো বেশ লোক। কখন ফাঁকি দিয়ে আগে চলে
এসেছ টেরও পাই নি।
২। সে তো ওর চিরকালের অভ্যেস। ও কখন ভিতরে ভিতরে এগিয়ে সবাইকে
ছাড়িয়ে চলে যায় বোঝাই যায় না। সেই তো আমাদের চবুয়াগাঁয়ের নেড়া বিভূতি, আমাদের একসঙ্গেই
কৈলেস-গুরুর কানমলা খেলে, আর কখন্ সে আমাদের সবাইকে ছাড়িয়ে এসে এতবড়ো কাণ্ডটা করে বসল।
৩। ওরে গবরু, ঝুড়িটা নিয়ে হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলি কেন? বিভূতিকে
আর কখনো চক্ষে দেখিস নি কি? মালাগুলো বের কর্, পরিয়ে দিই।
বিভূতি। থাক্ থাক্, আর নয়।
৩। আর নয় তো কী? যেমন তুমি হঠাৎ মস্ত হয়ে উঠেছ তেমনি তোমার
গলাটা যদি উটের মতো হঠাৎ লম্বা হয়ে উঠত আর উত্তরকূটের সব মানুষে মিলে তার উপর তোমার
গলায় মালার বোঝা চাপিয়ে দিত তাহলেই ঠিক মানাত।
২। ভাই, হরিশ ঢাকি তো এখনও এসে পৌঁছোল না।
১। বেটা কুঁড়ের সদ্দার, ওর পিঠের চামড়ায় ঢাকের চাঁটি লাগালে
তবে—
৩। সেটা কাজের কথা নয়। চাঁটি লাগাতে ওর হাত আমাদের চেয়ে মজবুত।
৪। মনে করেছিলুম বিশাই সামন্তের রথটা চেয়ে এনে আজ বিভূতিদাদার
রথযাত্রা করাব। কিন্তু রাজাই নাকি আজ পায়ে হেঁটে মন্দিরে যাবেন।
৫। ভালোই হয়েছে। সামন্তের রথের যে দশা, একেবারে দশরথ। পথের
মধ্যে কথায় কথায় দশখানা হয়ে পড়ে।
৩। হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ। দশরথ। আমাদের লম্বু এক-একটা কথা বলে ভালো।
দশরথ।
৫। সাধে বলি। ছেলের বিয়েতে ওই রথটা চেয়ে নিয়েছিলুম। যত চড়েছি
তার চেয়ে টেনেছি অনেক বেশি।
৪। এক কাজ কর। বিভূতিকে কাঁধে করে নিয়ে যাই।
বিভূতি। আরে করো কী। করো কী।
৫। না, না, এই তো চাই। উত্তরকূটের কোলে তোমার জন্ম, কিন্তু
তুমি আজ তার ঘাড়ে চেপেছ। তোমার মাথা সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছে।
কাঁধের উপর লাঠি সাজাইয়া তাহার উপর বিভূতিকে
তুলিয়া লইল
সকলে। জয় যন্ত্ররাজ বিভূতির জয়।
গান
নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র, নমো যন্ত্র।
তুমি চক্রমুখরমন্দ্রিত,
তুমি বজ্রবহ্নিবন্দিত,
তব বস্তুবিশ্ববক্ষোদংশ
ধ্বংসবিকট দন্ত।
তব দীপ্ত অগ্নি শত শতঘ্নী
বিঘ্নবিজয় পন্থ।
তব লৌহগলন শৈলদলন
অচলচলন মন্ত্র।
কভু কাষ্ঠলোষ্ট্রইষ্টকদৃঢ়
ঘনপিনদ্ধ কায়া,
কভু ভুতলজল-অন্তরীক্ষ-
লঙ্ঘন লঘুমায়া,
তব খনিখনিত্রনখবিদীর্ণ
ক্ষিতি বিকীর্ণ-অন্ত্র,
তব পঞ্চভূতবন্ধনকর
ইন্দ্রজালতন্ত্র।
(ক্রমশঃ ...)
0 মন্তব্যসমূহ