সাজাহান
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়
সাজাহান
প্রথম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
স্থান—আগ্রার
দুর্গপ্রাসাদ ; সাজাহানের কক্ষ। কাল—অপরাহ্ন
সাজাহান শয্যার উপর অর্ধশায়িত
অবস্থায় কর্ণমুল করতলে ন্যস্ত করিয়া অধোমুখে ভাবিতেছিলেন ও মধ্যে মধ্যে একটি আলবোলা টানিতেছিলেন।
সম্মুথে দারা দণ্ডায়মান।
সাজাহান। তাই ত ! এ
বড়-দুঃসংবাদ দারা!
দারা। সুজা
বঙ্গদেশে বিদ্রোহ করেছে বটে কিন্তু সে এখনও সম্রাট নাম নেয় নি; কিন্তু মোরাদ, গুর্জরে
সম্রাট নাম নিয়ে বসেছে, আর দাক্ষিণাত্য থেকে ঔরংজীব তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে।
সাজাহান। ঔরংজীব
তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে দেখি, ভেবে দেখি এ রকম কখনও ভাবি নি, অভ্যস্ত নই, তাই ঠিক ধারণা
কর্তে পার্ছি না- তাই ত ! (ধূমপান)
দারা। আমি কিছু
বুঝতে পার্ছি না।
সাজাহান। আমিও পার্ছি না। (ধূমপান)
দারা। আমি
এলাহাবাদে আমার পুত্র সোলেমানকে সুজার বিরুদ্ধে যাত্রা কর্বার জন্য লিখছি, আর তার সঙ্গে
বিকানীরের মহারাজ জয়সিংহ আর সৈন্যাধ্যক্ষ দিলীর খাঁকে পাঠাচ্ছি।
(সাজাহান আনতচক্ষে ধূমপান করিতে লাগিলেন।)
দারা। আর মোরাদের বিরুদ্ধে আমি
মহারাজ যশোবন্ত সিংহকে পাঠাচ্ছি ।
সাজাহান। পাঠাচ্ছ!
তাই ত! ( ধূমপান)
দারা। পিতা, আপনি
চিন্তিত হবেন না। এ বিদ্রোহ দমন কর্তে আমি জানি।
সাজাহান। না, আমি
তার জন্য ভাবছি না দারা; তবে এই ভাইয়ে ভাইয়ে। যুদ্ধ -তাই ভাবছি (ধূমপান ; পরে
সহসা) না–দারা, কাজ নেই। আমি তাদের বুঝিয়ে বলবো। কাজ নেই। তাদের নির্বিরোধে রাজধানীতে আসতে
দাও।
বেগে জাহানারার
প্রবেশ
জাহানারা। কখন না। এ হ’তে পারে না পিতা। প্রজা রাজার
উপর খড়্গ তুলেছে, সে খড়্গ তার নিজের স্কন্ধে পড়ুক।
সাজাহান। সে কি
জাহানারা ! তারা আমার পুত্র।
জাহানারা। হোক পুত্র। কি যায়
আসে। পুত্র কি কেবল পিতার স্নেহের অধিকারী ? পুত্রকে পিতার শাসনও কর্তে হবে।।
সাজাহান। আমার হৃদয়
এক শাসন জানে। সে শুধু স্নেহের শাসন। বেচারী। মাতৃহারা পুত্রকন্যারা আমার! তাদের
শাসন করবো কোন্ প্রাণে জাহানারা! ঐ চেয়ে দেখ– ঐ স্ফটিকে গঠিত (দীর্ঘনিশ্বাস) -ঐ তাজমহলের দিকে চেয়ে দেখ
– তার পর বলিস তাদের শাসন কর্তে।
জাহানারা। পিতা, এই
কি আপনার উপযুক্ত কথা! এই দৌর্বল্য কি ভারতসম্রাট সাজাহানকে সাজে! সাম্রাজ্য কি
অন্তঃপুর! একটা ছেলেখেলা! একটা প্রকাণ্ড শাসনের ভার আপনার উপর। প্রজা বিদ্রোহী হলে
সম্রাট কি তাকে পুত্র বলে ক্ষমা কর্বেন? স্নেহ কি কর্তব্যকে ছাপিয়ে উঠবে?
সাজাহান। তর্ক করিস
না জাহানারা। আমার কোন যুক্তি নাই ! আমার কেবল এক যুক্তি আছে। সে স্নেহ। আমি শুধু
ভাবছি দারা, যে, এ যুদ্ধে যে পক্ষেরই পরাজয় হয়, আমার সমান ক্ষতি। এ যুদ্ধে তুমি
পরাজিত হলে আমায় তোমার ম্লান-মুখখানি দেখতে হবে; আবার তারা পরাজিত হয়ে ফিরে গেলে তাদের ম্লান-মুখ কল্পনা কর্তে
হবে। কাজ নেই দারা। তারা রাজধানীতে আসুক; আমি তাদের বুঝিয়ে বলবো।
দারা। পিতা, তবে
তাই হোক।
জাহানারা। দারা,
তুমি কি এই রকম করে তোমার বৃদ্ধ পিতার প্রতিনিধির কাজ কর্বে ! পিতা যদি স্বয়ং শাসনক্ষম হতেন, তা
হলে তোমার হাতে তিনি রাজ্যের রশ্মি ছেড়ে দিতেন না। এই উদ্ধত সুজা, স্বকল্পিত সম্রাট
মোরাদ, আর তার সহকারী
ঔরংজীব বিদ্রোহের নিশান উড়িয়ে ডঙ্কা বাজিয়ে আগ্রায় প্রবেশ কর্বে, আর তুমি
পিতার প্রতিনিধি হয়ে তাই সহাস্যমুখে দাড়িয়ে দেখবে?—উত্তম !
দারা। সত্য পিতা, এ কি
হতে পারে? আমায় আজ্ঞা দিন পিতা।
সাজাহান। ঈশ্বর ! পিতাদের এই
বুকভরা স্নেহ দিয়েছিলে কেন? কেন তাদের হৃদয়কে লৌহ দিয়ে গড়নি? ওঃ!
দারা। ভাববেন না
পিতা, যে, আমি এ সিংহাসনের প্রত্যাশী। তার জন্য যুদ্ধ নয়। আমি এ সাম্রাজ্য চাই
না। আমি দর্শনে উপনিষদে এর চেয়ে বড় সাম্রাজ্য পেয়েছি। আমি যাচ্ছি আপনার সিংহাসন
রক্ষা কর্তে।
জাহানারা। তুমি
যাচ্ছ ন্যায়ের সিংহাসন রক্ষা কর্তে, দুষ্কৃতকে শাসন কর্তে, এই দেশের কোটি কোটি
নিরীহ প্রজাদের অরাজক অত্যাচারের গ্রাস থেকে বাঁচাতে। যদি রাজ্যে এই দুষ্প্রবৃত্তি শৃঙ্খলিত না
হয়, তবে এ মোগল সাম্রাজ্যের পরমায়ু আর কয় দিন ?
দারা। পিতা, আমি
প্রতিজ্ঞা কছি, ভাইদের কাউকে পীড়ন বা বধ কর্ব না, তাদের বেঁধে পিতার পদতলে এনে দেবো। পিতা তখন তাদের
ইচ্ছা হয়, ক্ষমা কর্বেন। তা’রা জানুক, সম্রাট সাজাহান স্নেহশীল—কিন্তু দুর্বল নয়।
সাজাহান। (উঠিয়া)
তবে তাই হোক। তারা জানুক যে, সাজাহান শুধু পিতা নয়- সাজাহান সম্রাট। যাও দারা! নাও এই
পাঞ্জা। আমি আমার সমস্ত ক্ষমতা তোমায় দিলাম। বিদ্রোহীর শাস্তি বিধান কর। (পাঞ্জা প্রদান )
দারা। যে আজ্ঞা
পিতা।
সাজাহান। কিন্তু এ
শাস্তি তা’দের একার নয়। এ শাস্তি আমারও। পিতা যখন পুত্রকে শাসন করে—পুত্র ভাবে যে, পিতা
কি নিষ্ঠুর! সে জানে না যে, পিতার উদ্যত বেত্রের অর্ধেকখানি পড়ে সেই পিতারই
পৃষ্ঠে।
প্রস্থান
(ক্রমশ ...)
0 মন্তব্যসমূহ