চিন্তনের দর্পণে কবি সুভাষ স্বপন ঘোষ
অরণ্যলোকের প্রবন্ধ
চিন্তনের দর্পণে কবি
সুভাষ
স্বপন ঘোষ
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বললে বেশী বলা হবে না।
উত্তর রাবীন্দ্রিক চল্লিশোত্তর সামাজিক – আত্মিক – জৈবসংকটের মধ্যেই ইনি বাংলা কাব্যে হাজির হয়েছিলেন। হাজির
হয়েই সামাজিক দায়বদ্ধতাকে গুরুত্ব দিয়েই পদাতিক কবি সানন্দে ঘোষণা করলেন – ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয়
অদ্য’ আজ যেন ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা, তাই কবি সকলকে আহ্বান জানান –
‘ডাকে বান ভাঙে বাঁধ, হাতে দাও হাত
ভাই,
দলে দলে কাধে কাধ, চল একসাথ ভাই।
আনো দিন হাতুড়ির , আননা দিন কাস্তের
খাদ্যের শিল্পের শিক্ষার
স্বাস্থ্যের।
কবির সেই আহ্বানের
পরিপূর্ণবাণী এখনও সার্থকতায় পৌছতে পারেনি। তাই কবির সেই অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত
করব এই অঙ্গীকারই আজ আমাদের বড় কাম্য।
কবি সুভাষ কবি হিসেবে যতখানি খ্যাতি অর্জন করেছেন – তার চেয়ে মানুষ হিসেবে
অনেকখানি খ্যাতি অর্জনের অধিকারী তিনি ছিলেন। তিনি মানুষের চেয়ে কবিতাকে বেশী করে
দাম দিতে রাজি ছিলেন না। কবিতা তার কাছে জীবন উপলব্ধির উপায় নয় কবিতা ছিল তার
কাছে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের মাধ্যম বিশেষ। কবিতা কবির কাছে যতটা দামী – তার চেয়ে মানুষের জীবন আরও অনেক বেশী দামী। তাই কবি
লিখেছিলেন –
“আমাকে কেউ কবি বলুক
আমি চাই না।।
কঁধে কাঁধ লাগিয়ে
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত
যেন হেঁটে যাই।
আমি যেন আমার কলমটা
ট্রাক্টরের পাশে
নামিয়ে রেখে বলতে পারিএই আমার ছুটি
ভাই, আমাকে একটু আগুন দাও।”
চিন্তনের দর্পণে
চেতনার আলোকের দীপ্ত শিখায় প্রভাকর কবি প্রতিভাকে মূল্যায়ণ করতে পারি। চিরনবীন – চিরসবুজ – অবুঝ প্রাণের কবি সুভাষ যৌবনের উদ্দাম সতেজ আস্পর্ধাহীন
মাথা উঁচু করে চলাকে চিরকাল উচ্ছাসের জয়গানে মুখরিত করে তোলেন –
“দুর্যোগের পথ হয় হোক দুর্বোধ্য,
চিনে নেবে যৌবন আত্মা।”
এরই সঙ্গের
প্রাত্যহিকতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের সমাজের লাঞ্ছনায়-অবহেলায় – উদাসীনতায় পিছিয়ে পড়া
মানুষের জীবন ও তাদের ভাবনাকে কবিতায় কবি উপস্থাপন করেন- “আমরা নই তো ভীরু জাত,
দেবো নাকো হতে দেশ বেহাত।
আজকে যদি না হানি আঘাত
দুষবে ভাবী সমাজ।”
ফুলকে কে না ভালবাসে?
কবিরও প্রিয় শব্দ ছিল ফুল। তাই কবি রাজনৈতিক – সামাজিক – অর্থনৈতিক – প্রেম চেতনার সংহত প্রকাশে ফুল-এর মাধ্যমে
পরিস্ফুট করে লিখে ছিলেন – ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। কিন্তু এই ফুলকে নিয়েও মানুষের বেসাতিপনা
কবিকে ভীষণ ভাবে আঘাত দিয়েছিল, তাই কবি একসময় সৌন্দর্যের শুভ্রতার – নির্মলের – পবিত্রতার প্রতীকী এই ফুলকেও
ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি-
“ফুলকে দিয়ে
মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনো দিনই আমার টান নেই।
তার চেয়ে আমার পছন্দ
আগুনের ফুলকি –
যা দিয়ে কোনদিন কারো মুখোশ হয় না।”
সুভাষ বাংলা কাব্যের বোধ হয় প্রথম কবি যিনি প্রেমের কবিতা দিয়ে কাব্য জীবন শুরু করেন
নি একথা বলেছিলেন কবি সমালোচক বুদ্ধদেব বসু। কিন্তু প্রেমহীন জীবন মানুষের কাছে কবরের
ন্যায় – একথা অস্বীকারের উপায় নেই। তাই সুভাষও পরবর্তী জীবনে বেশ কিছু প্রেম
বিষয়ক কবিতা লিখেছিলেন। তিনি প্রেমকে আবেগ সর্বস্ব শরীরী ভোগে বিচার না করে
হার্দিক বন্ধনে বিচার করতে চেয়েছেন-
“এ সংসারে।
দিনে রাত্রে
দেহ বলো, মন বলো।
যখন যা চাই
প্রেমের নিকষে ফেলে, প্রিয়তমা
করো সব কিছুর যাচাই।”
তাই কবি ভালোবাসার কষ্টি পাথরে প্রেমকে সুন্দরের প্রতিমূর্তিতে দেখান। সেজন্য তাঁর কাছে প্রেম
তত্ত্বকথাতে রূপান্তরিত হয়ে যায় –
“যখন তোমার দমকা হাওয়ায়
একা একা উড়ছিল
তখনও নয়।
বিকেলের পড়ন্ত রোদে বিন্দু বিন্দু ঘাম
তোমার মুখে যখন
মুক্তোর মত জ্বলছিল
তখনও নয়।
কী একটা কথায় আকাশ উদ্ভাসিত করে
তুমি যখন হাসলে
তখনও নয়
যখন ভোঁ বাজলেই
মাথায় চটের ফেঁসো জড়ানো একসমুদ্র
একটি করে ইস্তাহারের জন্যে
উত্তোলিত বাহুর তরঙ্গে তোমাকে ঢেকেছিল
যখন তোমাকে আর দেখা গেল না তখনই
আশ্চর্য সুন্দর দেখাল তোমাকে।”
এই সংরাগহীন ভালোবাসার পেলবতা কবিকে বারবার জীবনানন্দের ‘হায়চিল’ -এর মত নস্টালজিয়ায় নিয়ে
যেতে চায় – ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা
জাগাতে ভালবাসে’র
মত। তাই কবি বলেন—
“আমার ভালোবাসার কথা
মাকে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি।
মুখ বন্ধ করে
অক্লান্ত হাতে
হে জননী
আমার ভালোবাসার কথা বলে যাব।”
যা আবার অলংকারহীন
সহজ সরল প্রত্যয়ের সুরের ঝংকার-
“তোমার ঘৃণার দিকে
আমি ফিরিয়ে রেখেছি
আমার ভালোবাসার মুখ।”
এখানেই ভালোবাসা সার্থক। কবির কবিতাও রসোত্তীর্ণ। সাম্প্রতিক ঘোর সংকটের ঘূর্ণাবর্তেও সময় চেতনায়
ঋদ্ধ ছিলেন কবি সুভাষ। কাল চেতনার স্বাক্ষর পাওয়া যায় –
“এ এক ভারি অদ্ভুত সময়
কে কার আস্তিনের তলায় কার জন্যে
কোন হিংস্রতা লুকিয়ে রেখেছেআমরা জানি না।
কাধে হাত রাখতেও এখন আমাদের ভয়।”
কবির বড় পরিচয় ছিল মার্কসবাদী কবি। অবশ্যই মার্কসবাদ বিশ্ববীক্ষণ – মানবজাতির অগ্রগতির
দিক নির্দেশিকা। সময়ের যাত্রাপথে কবির জীবদ্দশা কম দিনের নয় (১৯১৯ – ২০০৩)। সঙ্গত কারনেই
পরিবর্তনশীল জগতের সঙ্গে কাব্যিক প্রয়াসকেই কবি বদলাতে চেয়েছেন। কিন্তু এতেই বাদ
সেধেছে রাজনীতি। তাই কবি বহুবার কারাবরণ করা সত্ত্বেও দলছুট হয়েছেন এতদিন পর্যন্ত
লালিত রাজনীতির ছায়াতল থেকে। মার্কসীয় বিজ্ঞান ঋদ্ধ প্রত্যয়ের কবি হয়েও শেষ
বেলায় নীচু গলার হার্দ উচ্চারণে নির্মান শিল্পে ধীরে ধীরে এগিয়েছেন সমসাময়িকতার
নানান প্রসঙ্গ নিয়ে, এবং পুঁজিবাদী সভ্যতার অর্থনীতির জটিল বিন্যাসকে
দূরদর্শীতায় প্রত্যক্ষ করেন এবং রাজনৈতিক দলের নির্দেশাবলীর দলবদলের পালা বদলেরও
কথা বলেন-
“এসো আজ জটিল পথে।
ঠিকানা বদলে প্রণয় খুঁজি।”
এবং
“অথর্ব নায়ক হবে গদিচ্যুত
দ্রুতগতি ইতিহাস,
এসেই কদম তার হয় যে অস্থির।”
এখানেই বাধা হয়ে দাঁড়ান সমসাময়িক রাজনীতিকরা। তাই কবি একঘরে হলেন, কিন্তু
কবির বিশ্ববীক্ষা থেমে থাকে নি। কবির চেতনা বিশ্বজনীনতায় উত্তীর্ণহয়।
সুভাষের কবিতার ছন্দোরীতি—অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তের সূক্ষ্মরীতি,
রূপকথা লোককথা – পুরাণ প্রসঙ্গের উপস্থাপনা, নাটকীয়তা ও গল্পময়তা সৃষ্টি,
ভাষা-উপমাচিত্রকল্প প্রয়োগ, আঙ্গিকের বিভিন্ন প্রকরণ – সর্বোপরি কবি হিসেবে সুভাষের অনুচ্চার্য কবি
প্রতিভা আমাদেরকে বিস্ময়াপন্ন করে তোলে। যা বিশ্বজনীন – যুগোত্তীর্ন প্রতিভারই স্বাক্ষর বলে মনে হয়।
যে কবি ছিলেন জীবনে অকুতোভয় – দুঃসাহসী, সমস্ত দলাদলি সংকীর্ণতা – রাজনীতির উর্ধ্বে
ও জাতপাতহীন মানবতাবাদী সাম্যবাদে বিশ্বাসী সেই কবিকে মহাপ্রয়ানের পর আধুনিক
রাজনীতির দলাদলির সমাজে যে নাট্য মঞ্চে হাজির হতে হবে তা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি – কিন্তু নাটক হল! এই নাটকের যবনিকাপাতও
ঘটল বহু রাজনীতি ঘেঁষাঘেষির দৃশ্যপটে। যে কবি জীবনে অন্যায়ের সঙ্গে অসত্যের সঙ্গে
কোনোদিন আপোষ করেন নি তার
মহাপ্রস্থানের পর সেই দেহের পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার মুহূর্ত ছিল বড়ই বেদনা দায়ক।
বড়ই হৃদয় বিদারক!
(অরণ্যলোক পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০০৩ সংখ্যায় প্রকাশিত।)
অরণ্যলোকের প্রবন্ধ
চিন্তনের দর্পণে কবি
সুভাষ
স্বপন ঘোষ
কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে বাংলা কবিতার ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র বললে বেশী বলা হবে না।
উত্তর রাবীন্দ্রিক চল্লিশোত্তর সামাজিক – আত্মিক – জৈবসংকটের মধ্যেই ইনি বাংলা কাব্যে হাজির হয়েছিলেন। হাজির
হয়েই সামাজিক দায়বদ্ধতাকে গুরুত্ব দিয়েই পদাতিক কবি সানন্দে ঘোষণা করলেন – ‘প্রিয় ফুল খেলবার দিন নয়
অদ্য’ আজ যেন ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা, তাই কবি সকলকে আহ্বান জানান –
‘ডাকে বান ভাঙে বাঁধ, হাতে দাও হাত
ভাই,
দলে দলে কাধে কাধ, চল একসাথ ভাই।
আনো দিন হাতুড়ির , আননা দিন কাস্তের
খাদ্যের শিল্পের শিক্ষার
স্বাস্থ্যের।
কবির সেই আহ্বানের
পরিপূর্ণবাণী এখনও সার্থকতায় পৌছতে পারেনি। তাই কবির সেই অসমাপ্ত কাজকে সমাপ্ত
করব এই অঙ্গীকারই আজ আমাদের বড় কাম্য।
কবি সুভাষ কবি হিসেবে যতখানি খ্যাতি অর্জন করেছেন – তার চেয়ে মানুষ হিসেবে
অনেকখানি খ্যাতি অর্জনের অধিকারী তিনি ছিলেন। তিনি মানুষের চেয়ে কবিতাকে বেশী করে
দাম দিতে রাজি ছিলেন না। কবিতা তার কাছে জীবন উপলব্ধির উপায় নয় কবিতা ছিল তার
কাছে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের মাধ্যম বিশেষ। কবিতা কবির কাছে যতটা দামী – তার চেয়ে মানুষের জীবন আরও অনেক বেশী দামী। তাই কবি
লিখেছিলেন –
“আমাকে কেউ কবি বলুক
আমি চাই না।।
কঁধে কাঁধ লাগিয়ে
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত
যেন হেঁটে যাই।
আমি যেন আমার কলমটা
ট্রাক্টরের পাশে
নামিয়ে রেখে বলতে পারিএই আমার ছুটি
ভাই, আমাকে একটু আগুন দাও।”
চিন্তনের দর্পণে
চেতনার আলোকের দীপ্ত শিখায় প্রভাকর কবি প্রতিভাকে মূল্যায়ণ করতে পারি। চিরনবীন – চিরসবুজ – অবুঝ প্রাণের কবি সুভাষ যৌবনের উদ্দাম সতেজ আস্পর্ধাহীন
মাথা উঁচু করে চলাকে চিরকাল উচ্ছাসের জয়গানে মুখরিত করে তোলেন –
“দুর্যোগের পথ হয় হোক দুর্বোধ্য,
চিনে নেবে যৌবন আত্মা।”
এরই সঙ্গের
প্রাত্যহিকতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা আমাদের সমাজের লাঞ্ছনায়-অবহেলায় – উদাসীনতায় পিছিয়ে পড়া
মানুষের জীবন ও তাদের ভাবনাকে কবিতায় কবি উপস্থাপন করেন- “আমরা নই তো ভীরু জাত,
দেবো নাকো হতে দেশ বেহাত।
আজকে যদি না হানি আঘাত
দুষবে ভাবী সমাজ।”
ফুলকে কে না ভালবাসে?
কবিরও প্রিয় শব্দ ছিল ফুল। তাই কবি রাজনৈতিক – সামাজিক – অর্থনৈতিক – প্রেম চেতনার সংহত প্রকাশে ফুল-এর মাধ্যমে
পরিস্ফুট করে লিখে ছিলেন – ‘ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত’। কিন্তু এই ফুলকে নিয়েও মানুষের বেসাতিপনা
কবিকে ভীষণ ভাবে আঘাত দিয়েছিল, তাই কবি একসময় সৌন্দর্যের শুভ্রতার – নির্মলের – পবিত্রতার প্রতীকী এই ফুলকেও
ব্যঙ্গ করতে ছাড়েন নি-
“ফুলকে দিয়ে
মানুষ বড় বেশি মিথ্যে বলায় বলেই
ফুলের ওপর কোনো দিনই আমার টান নেই।
তার চেয়ে আমার পছন্দ
আগুনের ফুলকি –
যা দিয়ে কোনদিন কারো মুখোশ হয় না।”
সুভাষ বাংলা কাব্যের বোধ হয় প্রথম কবি যিনি প্রেমের কবিতা দিয়ে কাব্য জীবন শুরু করেন
নি একথা বলেছিলেন কবি সমালোচক বুদ্ধদেব বসু। কিন্তু প্রেমহীন জীবন মানুষের কাছে কবরের
ন্যায় – একথা অস্বীকারের উপায় নেই। তাই সুভাষও পরবর্তী জীবনে বেশ কিছু প্রেম
বিষয়ক কবিতা লিখেছিলেন। তিনি প্রেমকে আবেগ সর্বস্ব শরীরী ভোগে বিচার না করে
হার্দিক বন্ধনে বিচার করতে চেয়েছেন-
“এ সংসারে।
দিনে রাত্রে
দেহ বলো, মন বলো।
যখন যা চাই
প্রেমের নিকষে ফেলে, প্রিয়তমা
করো সব কিছুর যাচাই।”
তাই কবি ভালোবাসার কষ্টি পাথরে প্রেমকে সুন্দরের প্রতিমূর্তিতে দেখান। সেজন্য তাঁর কাছে প্রেম
তত্ত্বকথাতে রূপান্তরিত হয়ে যায় –
“যখন তোমার দমকা হাওয়ায়
একা একা উড়ছিল
তখনও নয়।
বিকেলের পড়ন্ত রোদে বিন্দু বিন্দু ঘাম
তোমার মুখে যখন
মুক্তোর মত জ্বলছিল
তখনও নয়।
কী একটা কথায় আকাশ উদ্ভাসিত করে
তুমি যখন হাসলে
তখনও নয়
যখন ভোঁ বাজলেই
মাথায় চটের ফেঁসো জড়ানো একসমুদ্র
একটি করে ইস্তাহারের জন্যে
উত্তোলিত বাহুর তরঙ্গে তোমাকে ঢেকেছিল
যখন তোমাকে আর দেখা গেল না তখনই
আশ্চর্য সুন্দর দেখাল তোমাকে।”
এই সংরাগহীন ভালোবাসার পেলবতা কবিকে বারবার জীবনানন্দের ‘হায়চিল’ -এর মত নস্টালজিয়ায় নিয়ে
যেতে চায় – ‘কে হায় হৃদয় খুঁড়ে বেদনা
জাগাতে ভালবাসে’র
মত। তাই কবি বলেন—
“আমার ভালোবাসার কথা
মাকে কখনও আমি মুখ ফুটে বলতে পারি নি।
মুখ বন্ধ করে
অক্লান্ত হাতে
হে জননী
আমার ভালোবাসার কথা বলে যাব।”
যা আবার অলংকারহীন
সহজ সরল প্রত্যয়ের সুরের ঝংকার-
“তোমার ঘৃণার দিকে
আমি ফিরিয়ে রেখেছি
আমার ভালোবাসার মুখ।”
এখানেই ভালোবাসা সার্থক। কবির কবিতাও রসোত্তীর্ণ। সাম্প্রতিক ঘোর সংকটের ঘূর্ণাবর্তেও সময় চেতনায়
ঋদ্ধ ছিলেন কবি সুভাষ। কাল চেতনার স্বাক্ষর পাওয়া যায় –
“এ এক ভারি অদ্ভুত সময়
কে কার আস্তিনের তলায় কার জন্যে
কোন হিংস্রতা লুকিয়ে রেখেছেআমরা জানি না।
কাধে হাত রাখতেও এখন আমাদের ভয়।”
কবির বড় পরিচয় ছিল মার্কসবাদী কবি। অবশ্যই মার্কসবাদ বিশ্ববীক্ষণ – মানবজাতির অগ্রগতির
দিক নির্দেশিকা। সময়ের যাত্রাপথে কবির জীবদ্দশা কম দিনের নয় (১৯১৯ – ২০০৩)। সঙ্গত কারনেই
পরিবর্তনশীল জগতের সঙ্গে কাব্যিক প্রয়াসকেই কবি বদলাতে চেয়েছেন। কিন্তু এতেই বাদ
সেধেছে রাজনীতি। তাই কবি বহুবার কারাবরণ করা সত্ত্বেও দলছুট হয়েছেন এতদিন পর্যন্ত
লালিত রাজনীতির ছায়াতল থেকে। মার্কসীয় বিজ্ঞান ঋদ্ধ প্রত্যয়ের কবি হয়েও শেষ
বেলায় নীচু গলার হার্দ উচ্চারণে নির্মান শিল্পে ধীরে ধীরে এগিয়েছেন সমসাময়িকতার
নানান প্রসঙ্গ নিয়ে, এবং পুঁজিবাদী সভ্যতার অর্থনীতির জটিল বিন্যাসকে
দূরদর্শীতায় প্রত্যক্ষ করেন এবং রাজনৈতিক দলের নির্দেশাবলীর দলবদলের পালা বদলেরও
কথা বলেন-
“এসো আজ জটিল পথে।
ঠিকানা বদলে প্রণয় খুঁজি।”
এবং
“অথর্ব নায়ক হবে গদিচ্যুত
দ্রুতগতি ইতিহাস,
এসেই কদম তার হয় যে অস্থির।”
এখানেই বাধা হয়ে দাঁড়ান সমসাময়িক রাজনীতিকরা। তাই কবি একঘরে হলেন, কিন্তু
কবির বিশ্ববীক্ষা থেমে থাকে নি। কবির চেতনা বিশ্বজনীনতায় উত্তীর্ণহয়।
সুভাষের কবিতার ছন্দোরীতি—অক্ষরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত ও স্বরবৃত্তের সূক্ষ্মরীতি,
রূপকথা লোককথা – পুরাণ প্রসঙ্গের উপস্থাপনা, নাটকীয়তা ও গল্পময়তা সৃষ্টি,
ভাষা-উপমাচিত্রকল্প প্রয়োগ, আঙ্গিকের বিভিন্ন প্রকরণ – সর্বোপরি কবি হিসেবে সুভাষের অনুচ্চার্য কবি
প্রতিভা আমাদেরকে বিস্ময়াপন্ন করে তোলে। যা বিশ্বজনীন – যুগোত্তীর্ন প্রতিভারই স্বাক্ষর বলে মনে হয়।
যে কবি ছিলেন জীবনে অকুতোভয় – দুঃসাহসী, সমস্ত দলাদলি সংকীর্ণতা – রাজনীতির উর্ধ্বে
ও জাতপাতহীন মানবতাবাদী সাম্যবাদে বিশ্বাসী সেই কবিকে মহাপ্রয়ানের পর আধুনিক
রাজনীতির দলাদলির সমাজে যে নাট্য মঞ্চে হাজির হতে হবে তা আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারি নি – কিন্তু নাটক হল! এই নাটকের যবনিকাপাতও
ঘটল বহু রাজনীতি ঘেঁষাঘেষির দৃশ্যপটে। যে কবি জীবনে অন্যায়ের সঙ্গে অসত্যের সঙ্গে
কোনোদিন আপোষ করেন নি তার
মহাপ্রস্থানের পর সেই দেহের পঞ্চভূতে বিলীন হওয়ার মুহূর্ত ছিল বড়ই বেদনা দায়ক।
বড়ই হৃদয় বিদারক!
(অরণ্যলোক পত্রিকার সেপ্টেম্বর ২০০৩ সংখ্যায় প্রকাশিত।)
0 মন্তব্যসমূহ