বাংলা অলংকার
(আলোচনা - ১ম পর্ব)
অলঙ্কার বলতে কী বোঝ?
অলঙ্কার সাহিত্যের অন্তরঙ্গ ও বহিরঙ্গের সাজ-সজ্জা। ‘অলম্’
শব্দের এক অর্থ ভূষণ। যার দ্বারা ভূষণ করা হয়
তাই হল অলঙ্কার। অলঙ্কার যে সাহিত্যের সাজ-সঙ্জা, তা নামকরণ হতেও বোঝা যায়। অন্যদিকে দণ্ডীর মতে-“কাব্যশোভাকরান্ ধর্মান্ অলঙ্কারান্ প্রচক্ষতে”- কাব্যের
যে সমস্ত ধর্ম তার শোভা সম্পাদন করে, তা অলঙ্কার। এই সংজ্ঞা
অনুসারে অলঙ্কার বলতে সাহিত্যের সাধারণ সৌন্দর্যকেই বোঝানো হয়েছে। কিন্তু ব্যাপক অর্থ যাই হোক, অলঙ্কার বলতে আমরা সাহিত্যের উপমাদি বিশেষ লক্ষণগুলিকেই মনে করে থাকি। যেমন হার, চুড়ি ইত্যাদি নারীর দেহের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে, তেমনি
অনুপ্রাস-উপমা-রূপক ইত্যাদি সাহিত্যের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। তাই এগুলিকে সাহিত্যের অলঙ্কার বলা হয়ে থাকে। আলঙ্কারিক ভামহও বলেছেন,- “রূপকাদিঃ অলঙ্কার স্তস্যান্যৈর্বহু ধোদিতঃ’।
এককথায়, অনুপ্রাস-উপমাদি যে সমস্ত লক্ষণ সাহিত্যের সৌন্দর্য সম্পাদন ও রসের উৎকর্ষ সাধন করে, তাকে অলঙ্কার বলে।
নারীর স্বাভাবিক সৌন্দর্য থাকলেও সে গহনা পরিধান করে। তার প্রধান উদ্দেশ্য, আপন সৌন্দর্য বর্ধিত করা। আর যার
স্বাভাবিক সৌন্দর্য নেই, তার গহনার
দ্বারা আপনাকে বিভূষিত করার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি করে দেখা যায়। ভামহের মতে, নারীর মুখশ্রী মনোহর হলেও বিনা অলঙ্কারে তা দীপ্তি পায় না। সুতরাং দেখা যাচ্ছে,
নারী কুশ্রীই হোক আর সুশ্রীই হোক, গহনা তার পক্ষে একটি অতি
প্রয়োজনীয় সামগ্রী। তেমনি অলঙ্কার সাহিত্যের
পক্ষে একটি অত্যাবশ্যক উপকরণ। নিরলঙ্কার বাক্যও সুন্দর হতে পারে, কিন্তু যেখানে যথোপযুক্তভাবে অলঙ্কার থাকে, সেখানে
তা রচনা-সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেই। যখন মনের কথাকে শ্রোতার কাছে মনোহর করে তুলতে হয়, তখন অলঙ্কারের আশ্রয় গ্রহণ করা ছাড়া
গত্যন্তর থাকে না। নীরস বক্তব্যকে সরস করে প্রকাশ করবার পক্ষে অলংকার একটি অপরিহার্য অবলম্বন।
সুতরাং নারীর সৌন্দর্যের প্রসঙ্গে গহনার প্রয়োজনীয়তা যেমন অনস্বীকার্য,
তেমনি সাহিত্যের সৌন্দর্যের প্রসঙ্গে অলঙ্কারের প্রয়োজনীয়তাও
অনস্বীকার্য।
কিন্তু মনে রাখতে হবে, যথাসময়ে যথাস্থানে যথোচিতভাব
গহনা না পরলে যেমন গহনার মাহাত্ম্য থাকে না, তেমনি
সাহিত্যের মধ্যে যথাসময়ে যথাস্থানে যথোচিতভাবে অলঙ্কারের সমাবেশ না হলে তাহার মাহাত্ম্যও নষ্ট হয়ে যায়। (ক্রমশ...)
0 মন্তব্যসমূহ