আমার জীবন - রাসসুন্দরী দাসী
প্রথম ভাগ :: প্রথম রচনা :: জীবন-চরিত
[বাংলা সাহিত্যে প্রথম আত্মজীবনী রচয়িতা হলেন – শ্রীমতী রাসসুন্দরী দাসী (১৮০৯ – ১৮৯৯ খ্রিঃ)। গ্রন্থটির নাম হল – ‘আমার জীবন’। এটি প্রথম প্রকাশিত হয়
১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে।
গ্রন্থটির তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৩১৩ বঙ্গাব্দে। এই তৃতীয় সংস্করণে রাসসুন্দরী
দেবীর লেখা আত্মজীবনীর সঙ্গে আত্মজীবনীটির সম্পর্কে জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর ও
দীনেশচন্দ্র সেনের রচনাও প্রকাশিত হয়। ‘আমার জীবন’ গ্রন্থের দুটি ভাগ – প্রথম
ভাগে জীবনকথা বর্ণিত, দ্বিতীয় ভাগে ভগবৎ বন্দনা বর্ণনা আছে। গ্রন্থের
প্রথম ভাগে মঙ্গলাচরণ ও ১৬টি রচনা এবং দ্বিতীয় ভাগে আছে ১৫টি রচনা ও মনশিক্ষা। শ্রী
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর এই গ্রন্থের সম্পর্কে যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “ইহার জীবনের ঘটনাবলী এমন বিস্ময়জনক এবং ইহার লেখায় এমন একটি অকৃত্রিম সরল
মাধুর্য আছে যে, গ্রন্থখানি পড়িতে বসিয়া শেষ না করিয়া
থাকা যায় না।” এই পর্বে দেওয়া হল এই জীবনীগ্রন্থটির মূল
রচনা – প্রথম ভাগ, প্রথম রচনা; জীবন-চরিত।] |
আমার জীবন - রাসসুন্দরী দাসী |
মঙ্গলাচরণ
বন্দে সরস্বতী মাতা, তুমি বল বুদ্ধিদাতা,
গন্ধর্ব্ব কিন্নর তব বাধ্য।
সদয় হইয়া মনে,
বৈস্য মম হৃদাসনে,
প্রণমিব পদে যথাসাধ্য।।
অবোধ অবলা কন্যা, নিজগুণে কর ধন্যা,
যাতে মম পুরে অভিলাষ।
এই আশা করি মনে, তবে প্রিয়পতি সনে,
আমার কণ্ঠেতে কর বাস।।
প্রথম রচনা :: জীবন-চরিত
কোথা বাঞ্ছাকল্পতরু প্রভু বিশ্বেশ্বর।
হৃদয়ে বসিয়া মম বাঞ্ছা পূর্ণ কর।।
অজ্ঞান অধম আমি তাহে নারী ছার।
তব গুণ বর্ণিবারে কি শক্তি আমার।।
তবু তব কীর্তন করিতে সাধ মনে।
রাসসুন্দরীকে দয়া কর নিজগুণে।।
১২১৬ সালে চৈত্র মাসে আমার জন্ম হয়, আর এই ১৩০৩ সালে আমার বয়ঃক্রম ৮৮ বৎসর হইল। আমি
ভারতবর্ষে আসিয়া এত দীর্ঘকাল যাপন করিলাম।
আমার এই শরীর, এই মন, এই জীবনই কয়েক প্রকার হইল। আমার শরীরের অবস্থা, মনের
ভাব, কোন্ সময়ে কি প্রকার ছিল, এবং
কোন্ অবস্থায় কত দিবস গত হইয়াছে, সে সমুদয় আমার স্মরণ নাই। যৎকিঞ্চিৎ যাহা আমার মনে আছে, তাহাই
লিখিতেছি:
চারি পাঁচ বৎসর পর্যন্ত আমার শরীরের
অবস্থা এবং মনের ভাব কি প্রকার ছিল, তাহা আমি কিছুই জানি না;
সে সমুদয় আমার মা জানেন। পরে যখন আমি ছয় সাত বৎসরের ছিলাম,
তখনকার কথা আমার কিছু কিছু মনে আছে। যাহা আমার মনে আছে তাহাই
লিখিতেছি। তখন আমি প্রতিবাসিনী বালিকাদিগের সঙ্গে ধূলাখেলা করিতাম। ঐ সকল বালিকা বিনা অপরাধেই আমাকে মারিত। আমার মনে এত ভয় ছিল যে, আমি মার খাইয়াও বড় করিয়া কাঁদিতাম না, কেবল দুই চক্ষের জল পড়িয়া ভাসিয়া যাইত। আমার যদি অতিশয় বেদনা হইত সে
জন্যও কতক কাঁদিতাম, কিন্তু আমার কাঁদার বিশেষ কারণ এই, যে আমাকে মারিয়াছে, আমাদের বাটীতে সকলে শুনিলে উহাকে গালি দিবেন। আর একটি কথা মনে পড়ায় আমি কাঁদিতাম: এক দিবস আমার মা আমাকে বলিয়াছিলেন, তুমি কোনখানে যাইও না। তখন আমি মাকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, মা। যাব না কেন? তখন আমার মা বলিলেন, আজ বড় ছেলে-ধরা আসিয়াছে, সে ছেলে পাইলে ছালার
মধ্যে পুরিয়া লইয়া যায়। মার এ কথা শুনিয়া আমার মনে এত ভয় হইল যে, আমার এককালে মুখ শুকাইয়া গেল। আমার এ সকল
ভয়ের লক্ষণ দেখিয়া আমার মা তাড়াতাড়ি আসিয়া আমাকে কোলে লইয়া এই বলিয়া সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন, ষাট, তোমার
ভয় নাই। যে সকল ছেলে দুষ্টামি করে এবং ছেলেপিলেকে মারে এ সকল ছেলেকে ছেলে-ধরায়
লইয়া যায়। তোমার ভয় কি, তোমাকে লইয়া যাইবে না।
মার এ কথা আমার মনে মনেই থাকিল। যখন কোন ছেলে আমাকে
মারিত,
তখন মার ঐ কথা আমার মনে পড়িত। মা বলিয়াছেন
যে ছেলে ছেলেপিলেকে মারে তাহাকে ছেলে-ধরায় ধরিয়া লইয়া যায়। অতএব যখন কোন ছেলে
আমাকে মারিত, তখন ভয়ে আমি বড় করিয়া কাঁদিতাম না। উহাকে ছেলে-ধরায় ধরিয়া লইয়া যাইবে, কেবল
এই ভয়ে দুই চক্ষু দিয়া জল পড়িত। আমাকে মারিয়াছে এই কথাও কাহারও নিকট বলিতাম না।
আমি কাঁদিলে কেহ শুনিবে এই ভয়ে মরিতাম। সকলে জানিত, আমাকে মারিলে আমি কাহার নিকট বলিব না।
আমি সকল বালিকাকে ভয় করিতাম, এজন্য গোপনে গোপনে সকলেই বিনা
অপরাধে আমাকে মারিত।
এক দিবস আমার সঙ্গিনী একটি বালিকা আমাকে গোপনে বলিল, তোমার মায়ের কাছে গিয়া জলপান চাহিয়া আন। আমরা দুই জনে গঙ্গাস্নানে যাই। শুনিয়া আমি ভারী আহ্লাদিত হইয়া মায়ের
নিকট গিয়া বলিলাম, মা! আমি গঙ্গাস্নানে
যাইব। মা হাসিয়া বলিলেন, গঙ্গাস্নানে
যাইবে, কি চাও। আমি বলিলাম, একটা বোচ্কা
চাই। গঙ্গাস্নানের অর্থ আমি বিশেষ কিছুই জানি না; এই মাত্র জানি, পথে বসিয়া জলপান খায়, আর কাপড়ে একটা বোচ্কা বাঁধিয়া মাথায় করিয়া পথে হাঁটিয়া যায়। আমার
মা আমার সকল অভিপ্রায় বুঝিতে পারিয়া একখানি কাপড়ে কিছু জলপান, দুটি আম বাঁধিয়া একটি পুঁটলি করিয়া আমাকে আনিয়া
দিলেন। তখন এ পুঁটলি দেখিয়া আমার মনে যে কি পর্যন্ত আহ্লাদ হইল তাহা আমি বলিতে পারি না। আমার বোধ হইল, আমি যেন
কত অমূল্য রত্নই প্রাপ্ত হইলাম, আমার
আনন্দের আর সীমা থাকিল না। এখন তাহার শতগুণ বেশী আহ্লাদের কাজ হইলেও তেমন আহ্লাদ মনে বোধ হয় না। আহা! সে যে
কি আহ্লাদের দিন ছিল, তাহা বলা যায়
না। তখন আমি এ পুঁটলি লইয়া সেই বালিকার সঙ্গে গঙ্গাস্নানে চলিলাম। পরে এক পুষ্করিণীর ধারে বসিয়া জলপান খুলিলাম। তখন আমার সঙ্গিনী
বালিকা আমাকে বলিল, দেখ, তুমি যেন আমার
মা, আমি যেন তোমার ছেলে। তুমি আমাকে কোলে লইয়া খাওয়াইয়া
দাও। তখন আমি বলিলাম, তবে তুমি আমার কোলের কাছে বৈস। তখন সে
আমার কোলের কাছে বসিল। আমি বলিলাম, আচ্ছা তবে খাও। এই বলিয়া
ঐ সকল জলপান উহাকে খাওয়াইয়া দিলাম। পরে সে বলিল, আঁচাইয়া দাও। তখন আমি ভারি বিপদে পড়িলাম। কি করিব ভাবিতে লাগিলাম। আমি জলে
নামিয়াও জল আনিতে পারিলাম না। অনেক চেষ্টা করিয়া দেখিলাম, কোন
মতেই কৃতকার্য হইতে পারিলাম না। আমার সঙ্গিনী এ অপরাধে আমাকে একটা চড় মারিল। আমি
মার খাইয়া ভয়ে কাঁপিতে লাগিলাম। আমার দুই চক্ষে জল পড়িতে
লাগিল। আমি অমনি দুই হাত দিয়া চক্ষের জল মুছিয়া ফেলিলাম। আর মনে মনে ভাবিতে
লাগিলাম যে, আমাকে মারিতে কেহ বুঝি দেখিল, এই ভয়ে আমি চারিদিক তাকাইতে লাগিলাম।
ঐ সময়ে আমার খেলার সঙ্গিনী আর একটি বালিকা
সেই স্থানে ছিল। সে উহাকে বলিল, তুমি কেমন মেয়ে! উহার সকল
জলপান খাইলে, আম দুটাও খাইলে, আবার উহাকে
মারিয়া কাঁদাইতেছ। আমি গিয়া উহার মায়ের কাছে বলিয়া দিই।
এই বলিয়া সে আমাদের বাটীতে গিয়া সকলের নিকট বলিয়া পুনর্ব্বার আমাদের নিকট আসিয়া বলিল, আমি তোমার মায়ের কাছে
সকল কথা বলিয়া দিয়াছি। দেখ এখনি, কি করে। এ কথা শুনিয়া
আমার ভারি ভয় হইল, আমি কাঁদিতে
লাগিলাম। তখন আমার গঙ্গাস্নানের সঙ্গিনী বালিকা বলিল,
উনি একটি সোহাগের আরশি, কিছু না বলিতেই কাঁদিয়া উঠেন! এই বলিয়া আমার মুখে আর একটা ঠোকনা মারিল। তখন আমার অত্যন্ত
ভয় হইল, আমি চক্ষের জল মুছিয়া মনে মনে ভাবিতে লাগিলাম,
আমি সোহাগের আরশি হইয়াছি, না জানি, আমার কি হইল! তখন আমার এই ভয়ই হইতে লাগিল, আজি
আমাকে ছেলে-ধরা ধরিয়া লইয়া যাইবে, উহাকেও বুঝি লইয়া
যাইবে। এই ভয়ে আমি আমাদের বাটীতে না গিয়া এ গঙ্গাস্নানের সঙ্গিনীর বাটীতেই গেলাম। তখন উহার মা আমার মুখের দিকে চাহিয়া উহাকে
বলিল, উহার মুখ লাল হইয়াছে কেন? তুমি
বুঝি উহাকে কাঁদাইয়াছ?
এই বলিয়া তাহার মা গালি দিল। সে তাহার মায়ের কথা শুনিয়া হাসিতে
লাগিল। পরে তাহার মা গেলে, সে আমাকে বলিল, দেখ,
আমার মা আমাকে গালি দিল, আমি তো তোমার মত কাঁদিলাম না। তুমি যেমন আহ্লাদে মেয়ে হইয়াছ। তুমি
বুঝি তোমার মায়ের কাছে গিয়া সকল কথা বলিয়া দিবে। তখন আমি মাথা নাড়িয়া বলিলাম,
না, আমি মায়ের কাছে গিয়া সকল কিছুই বলিব না;
ইহা বলিয়া আমি বিষণ্ণবদনে সেই স্থানে বসিয়া
থাকিলাম। কিছুক্ষণ পরে আমাদের বাটী হইতে একজন লোক আসিয়া আমাকে বাটী লইয়া গেল।
আমি বাটী গিয়া দেখিলাম, সকলেই আমার এ সকল কথা বলিয়া হাসিতেছে।
আমাকে দেখিয়া গঙ্গাস্নান হইয়াছে বলিয়া আরও হাসিতে লাগিল। তখন আমার খুড়া,
দাদা এবং অন্যান্য সকলেও বলিতে লাগিলেন, আর এ
সকল মেয়েদের সঙ্গে উহাকে খেলিতে দেওয়া হইবে না। কল্য হইতে উহাকে বাহির বাটীতেই
রাখা যাইবে। তখন সে একদিন ছিল, এখনকার মত মেয়েছেলেরা
লেখাপড়া শিখিত না। বাঙ্গালা স্কুল আমাদের বাটীতেই ছিল। আমাদের গ্রামের সকল ছেলে
আমাদের বাটীতেই লেখাপড়া করিত। একজন মেমসাহেব ছিলেন, তিনিই
সকলকে শিখাইতেন। পর দিবস প্রাতে আমার খুড়া আমাকে কালো রঙের একটা ঘাগরা পরাইয়া
একখানা উড়ানী গায়ে দিয়া সেই স্কুলে মেমসাহেবের কাছে বসাইয়া রাখিলেন। আমাকে
যেখানে বসাইয়া রাখিতেন, আমি সেইখানেই বসিয়া থাকিতাম। ভয়ে
আমি আর কোনদিকে নড়িতাম না। তখন আমার বয়ঃক্রম আট বৎসর। তখন
আমার শরীরের অবস্থা কি প্রকার ছিল, তাহা আমি বলিতে পারিনা।
কিন্তু সকলে যাহা বলিত, যাহা শুনিয়াছি, তাহাই বলিতেছি:
বর্ণটি আছিল মম অত্যন্ত উজ্জ্বল।
উপযুক্ত তারি ছিল গঠন সকল।।
সেই পরিমাণে ছিল হস্তপদগুলি।
বলিত সকলে মোরে সোণার পুতুলী।।
আমি কাহারও সঙ্গে কথা কহিতাম না। আমারে মুখে পরিষ্কৃত হইয়া কথা বাহির হইত না। যে দুই একটি কথা বাহির হইত, সেও আধ-আধ, তাহা শুনিয়া সকলে হাস্য করিত। আমাকে যদি
কেহ বড় করিয়া ডাকিত, তাহা হইলেই আমার কান্না উপস্থিত হইত। বড় কথা শুনিলেই, আমার চক্ষের জলে বুক
ভাসিয়া যাইত। এজন্য আমার সঙ্গে কেহ
বড় করিয়া কথা কহিত না; আমি সকল দিবস সেই স্কুলেই থাকিতাম।
মেয়েছেলের মত আমাকে বাটীর মধ্যে রাখা হইত না। তখন ছেলেরা ক খ চৌত্রিশ অক্ষরে মাটিতে লিখিত, পরে এক নড়ি হাতে লইয়া ঐ সকল লেখা উচ্চৈঃস্বরে পড়িত। আমি সকল সময়ই
থাকিতাম। আমি মনে মনে ঐ সকল পড়াই শিখিলাম। সেকালে পারসী
পড়ার প্রাদুর্ভাব ছিল। আমি মনে মনে তাহাও খানিক শিখিলাম।
আমি যে ঐ সকল পড়া মনে মনে শিখিয়াছি, তাহা
আর কেহ জানিত না। আমাকে পরিজনেরা সমস্ত দিন বাহিরে রাখিতেন। কেবল স্নানের সময়ে
বাটীর মধ্যে আনিয়া স্নান আহারের পরেই আবার বাহিরে রাখিয়া আসিতেন, আর সন্ধ্যার পূর্ব্বে বাটীর মধ্যে আনিতেন। এই প্রকার
সকল দিবস আমি স্কুলে সেই মেম সাহেবের কাছেই বসিয়া থাকিতাম। তখন আমার মনের অবস্থা
কি প্রকার ছিল তাহা আমি বুঝিতে পারি নাই। ভয় যেন আমার মন এককালে জড়াইয়া
রাখিয়াছিল। যদিও মনে কখনও একটু অঙ্কুরিত হইয়া উঠিত, অমনি
ভয় আসিয়া চাপা দিয়া রাখিত।
(ক্রমশঃ ... পরের পর্বে দ্বিতীয় রচনা)
0 মন্তব্যসমূহ