Header Ads Widget

WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা ** WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা **

ticker

6/recent/ticker-posts

আমার জীবন - রাসসুন্দরী দাসী (প্রথম ভাগ - তৃতীয় রচনা)

 আমার জীবন - রাসসুন্দরী দাসী 
(প্রথম ভাগ - তৃতীয় রচনা) 
Amar Jibon - Rassundari Dasi


আমি অতি মুঢ়মতি, না জানি ভকতি স্তুতি,
বিষয় বিষেতে জরা মনে।
তাহাতে শকতিহীন    মৃত্যু প্রায় নিশিদিন 
আছি নাথ তব অর্দশনে।।
লজ্জা ভয়ে অঙ্গ দয়, কি বিবন্ধ দয়াময়,
কি করিব না দেখি উপায়।
অধিনীর অনুরোধেত্বরায় প্রকাশ হৃদে,
কৃপা করি ওহে দয়াময়।।
করুণার কল্পতরু, কৃপাসিন্ধ বিশ্বগুরু,
কর দৃষ্টি করুণা নয়নে।
অকূল তরঙ্গে পড়ি    ভাসিছে রাসসুন্দরী
তোমার চরণ-তরি বিনে।

    আমার মা বলিলেন, এই যে, আমাদের দালানে ঠাকুর আছেন, তাঁহারি নাম দয়ামাধব, তিনি ঠাকুর। কল্য তোমাদের যে লোক নদীর কূল হইতে কোলে করিয়া বাটীতে আনিয়াছিল, সে মানুষ। তখন আমি বলিলাম, মা তুমি বলিয়াছিলে, ভয় হইলে দয়ামাধবকে ডাকিও, আমাদের দয়ামাধব আছেন। তবে যে কালি যখন ভয় হইল, আমরাদয়ামাধব, দয়ামাধব বলিয়া কত ডাকিলাম, আইলেন না কেন? মা বলিলেন, ভয় পাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে দয়ামাধব, দয়ামাধব বলিয়া ডাকিয়াছিলে। দয়ামাধব তোমাদের কান্না শুনিয়া মানুষ পাঠাইয়া দিয়া তোমাদিগকে বাটীতে আনিয়াছেন। আমি তখন মাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, মা! দয়ামাধব দালানে থাকিয়া কেমন করিয়া আমাদের কান্না শুনিলেন? মা বলিলেন, তিনি পরমেশ্বর, তিনি সর্ব স্থানেই আছেন, এজন্য শুনিতে পান। তিনি সকলের কথাই শুনেন।
 
    সেই পরমেশ্বর আমাদিগের সকলকে সৃষ্টি করিয়াছেন। তাঁহাকে যে যেখানে থাকিয়া ডাকে, তাহাই তিনি শুনেন। বড় করিয়া ডাকিলেও তিনি শুনেন, ছোট করিয়া ডাকিলেও শুনেন, মনে মনে ডাকিলেও শুনিয়া থাকেন; এজন্য তিনি মানুষ নহেন, পরেমেশ্বর। তখন আমি বলিলাম, মা! সকল লোক যে পরমেশ্বর পরমেশ্বর বলে, সেই পরমেশ্বর কি আমাদের? মা বলিলেন, হাঁ, এ এক পরমেশ্বর সকলেরি, সকল লোকেই তাঁহাকে ডাকে, তিনি আদি কর্তা। এই পৃথিবীতে যত বস্তু আছে, তিনি সকল সৃষ্টি করিয়াছেন, তিনি সকলকেই ভালবাসেন, তিনি সকলেরই পরমেশ্বর।
 
    বাস্তবিক পরমেশ্বর যে কি বস্তু, তাহা আমি এ পর্যন্ত বুঝিতে পারি নাই। সকল লোক পরমেশ্বর বলে, তাহাই শুনিয়া থাকি- এই মাত্র জানি। মা বলিলেন, তিনি ঠাকুর, এজন্য সকলের মনের ভাব জানিতে পারেন। মার এ কথা শুনিয়া আমার মন অনেক সবল হইল। বিশেষ সেই দিবস হইতে আমার বুদ্ধির অঙ্কুর হইতে লাগিল। আর পরমেশ্বর যে আমাদের ঠাকুর, তাহাও আমি সেই দিবস হইতে জানিলাম। আর আমার মনে অধিক ভরসা হইল। পরমেশ্বরকে মনে মনে ডাকিলেও তিনি শুনেন, তবে আর কিসের ভয়, এখন যদি আমার ভয় করে, তবে আমি মনে মনে পরমেশ্বর বলিয়া ডাকিব। মার ঐ কথা আমার চিরস্থায়ী হইয়াছে, মা বলিয়াছেন, আমাদের পরমেশ্বর আছেন।
 
    সেই দিবস হইতে আমি মায়ের মহামন্ত্র পরমেশ্বর নামটি আমার হৃদয়ে প্রবেশ করিয়াছে। আমি আট বৎসর পর্যন্ত বালিকাদিগের সঙ্গে ধূলা-খেলা করিতাম। আর দুই বৎসর বাহির বাটীর স্কুলে মেম সাহেবের নিকট বসিয়া থাকিতাম। এই অবস্থায় দশ বৎসর গত হইয়াছে। পরে আমাদের বাটী পুড়িয়া গিয়া বাটীর স্কুল ভাঙ্গিয়া গেল। সেই হইতে আমার বাহির বাটী যাওয়া রহিত হইল। আর আমি বাহির বাটীতে যাইতাম না। বাটীর মধ্যেই থাকিতাম। আমার মামা গৃহশূন্য হইয়াছেন, তাঁহার ছোট একটি ছেলে ছিল, আমার মা এ ছেলেকে আনিলেন। আমি ছেলেটিকে দেখিয়া ভারি সন্তুষ্ট হইলাম। ঐ ছেলেটিকে আমি সকল দিবস কোলে করিয়া রাখিতাম, উহাকে লইয়াই আমি খেলা করিতাম, সে-ছেলেটিও আমার কাছে থাকিতে থাকিতে আমার ভারি শরণাগত হইল। আমি তাহাকে অতিশয় ভালবাসিতাম। এমনকি স্নান, আহার, নিদ্রা সকল সময়েই সে আমার কোলে থাকিত, আমি তাহাকে একবারও কাঁদিতে দিতাম না।

আমাদের বাটীর নিকট জ্ঞাতি খুড়ার বাটী আছে। সেই বাটীতে এক খুড়ীমা ছিলেন। আমি এ ছেলেটি লইয়া সেই খুড়ীমার নিকট সকল দিবস থাকিতাম। সে-বাটীতে অধিক লোক ছিল না, খুড়ারা তিন জন, আর খুড়ীমা, আর ছেলেপিলে কয়েকটি মাত্র। সে খুড়ীমার হাতে পায়ে রস-বাতের বেদনা ছিল। আমি ছেলে লইয়া সকল সময় খুড়ীমার কাছে থাকিতাম, তিনি সংসারের সকল কাজ করিতেন, আর আমার কাছে বসিয়া সকল কাজের কথা বলিয়া কাঁদিতেন। আর বলিতেন, আমার মরণ হইলেই বাঁচি, আমি আর কাজ করিতে পারি না।
 
    খুড়ীমার সকল খেদোক্তি শুনিয়া আমার মনে ভারি কষ্ট হইত। তখন আমি কোন কাজ করিতে জানি না, তথাপি খুড়ীমার কষ্ট দেখিয়া আমার অত্যন্ত কষ্ট বোধ হইত। এক দিবস আমি বলিলাম, তুমি বসিয়া থাক, আমি কাজ করি। তিনি বলিলেন, তুমি কি কাজ করিতে পার? আমি বলিলাম, আমাকে বলিয়া দিলে আমি সকল কাজই করিতে পারি। তিনি বলিলেন, তোমাকে তো কোন কাজ করিতে দেখিনে, তুমি কি কাজ জান, বিশেষ তোমাকে কাজ করিতে কেহ দেখিলে আমাকে গালি দিবে। তখন আমি বলিলাম, তুমি কাহারও নিকট বলিও না, আমাকে বলিয়া দাও, আমি কাজ করি।
 
    তখন তিনি বলিয়া বলিয়া দিতে লাগিলেন, আমি আহ্লাদে নাচিয়া নাচিয়া সকল কাজ করিতে লাগিলাম। এই প্রকার করিয়া আমি ক্রমে ক্রমে এ খুড়ীমার কাছে যাবতীয় কাজ করিতে শিখিলাম। তিনি বসিয়া পাক করিতেন, আমি এ পাকের সমুদয় প্রস্তুত করিয়া দিতাম, এই প্রকার কাজ করিতে করিতে আমিও পাক করিতে শিখিলাম। আমি এ বাটীর সকলকে পাক করিয়া দিতাম। আমি যে এ সকল কাজ শিখিয়াছি, আমাদের বাটীতে কেহ জানিত না। সেই খুড়ীমা আমাকে যৎপরোনাস্তি স্নেহ করিতেন, আমি সর্ব্বদা তাঁহার নিকটে থাকিতাম।
 
    এই প্রকারে কিছু দিবস যায়। এক দিবস আমি সেই খুড়ীমার মাথাতে তৈল দিতেছিলাম। ইতিমধ্যে আমার পিসি আসিলেন। আমি পিসিমাকে দেখিয়া ঘরের মধ্যে গিয়া লুকাইয়া থাকিলাম, তিনি আমাকে দেখিতে পাইয়া বলিলেন, মা! আমাকে দেখিয়া লুকাইলে কেন? তখন আমার খুড়ীমা বলিলেন, আমার মাথাতে তৈল দিতেছিল, পাছে তুমি কিছু বল, এই ভয়ে পলাইয়াছে। এ কথা শুনিয়া পিসি হাসিতে হাসিতে ঘর হইতে আমাকে কোলে করিয়া আনিয়া বলিলেন, তুমি কি এখন কাজ করিতে পার, কাজ কোথায় শিখিয়াছ? খুড়ীমা বলিলেন, মেয়ে তো বেশ কাজ জানে । আমি হাত পায়ের বেদনাতে নড়িতে পারি না, ওই আমার সকল কাজ করিয়া দেয়। আমি উহার জন্যেই বাঁচি। পিসি শুনিয়া ভারি সন্তুষ্ট হইয়া, আমাকে কোলে লইয়া, আমাদের বাটীতে.গিয়া বলিতে লাগিলেন, তোমরা শুনিয়াছ, এই মেয়ে কত কাজ শিখিয়াছে, ও বাড়ির বৌ রস-বাতে মরে, কোন কাজ করিতে পারে না, সে বলিল, তাহার সকল কাজ, এমনকি, রান্না পর্যন্ত এই মেয়ে করিয়া দেয়। আমাদের বাটীর সকলে শুনিয়া হাসিতে লাগিল, আমার মা আমাকে কোলে লইয়া আহ্লাদে ভাসিতে লাগিলেন। আমাকে বলিলেন, মা! কাজ কোথা শিখিয়াছ, কাজ করিয়া একবার দেখাও দেখি। তখন আমি আমাদের বাটীতেও কাজ করিতে আরম্ভ করিলাম। সেই হইতে আমি বাটীর কাজ করিতাম। কিন্ত আমাদের বাটীতে আমাকে কেহ কাজ করিতে দিতেন না, আমি গোপনে গোপনে কাজ করিয়া রাখিতাম, তাহা দেখিয়া সকলে সন্তুষ্ট হইয়া আমাকে কত সোহাগ করিতেন। সেই হইতে আমার ধুলা-খেলা ভাঙ্গিল; আর খেলা ছিল না, আমি কেবল কাজই করিতাম।
 
    এইরূপে সংসারের সমুদয় কাজ শিখিয়াছি। দুই বৎসর পর্যন্ত আমি এ বাটীতে খুড়ীমার কাছে সেই ছেলেটিকে লইয়া সকল দিবস থাকিতাম। ছেলেটি আমার কাছে থাকিতে থাকিতে আমার ভারি অনুগত হইল। আমিও তাহাকে এক তিল ছাড়িয়া থাকিতে পারিতাম না। দৈবাৎ সে ছেলেটি পীড়িত হইয়া মারা গেল। ছেলেটি মারা গেলে আমার অত্যন্ত কষ্ট হইতে লাগিল। তখনও আমি খুড়ীমার কাছেই থাকিতাম। তখন আমার বয়ঃক্রম সম্পূর্ণ বারো বৎসর। এত দিবস আমার এই সকল অবস্থায় গত হইয়াছে। এই বার বৎসর কাল আমি আমোদ-আহ্লাদে পরিবারের নিকটে মার কোলে নির্ভাবনায় সুখে ছিলাম।
 
পরে ক্রমে ক্রমে আবার ভাবনা আসিয়া উপস্থিত হইতে লাগিল। বার বৎসরে আমার বিবাহ হয়। এ বিষয়ে আমি পূর্ব্বে কিছুই জানিতাম না। এক দিবস আমি খিড়কির ঘাটে স্নান করিতে গিয়াছি, সে সময় ঘাটে অনেক লোক আছে। ইতিমধ্যে আমাকে দেখিয়া একজন লোক বলিল, এ মেয়েটিকে যে পাইবে, সে কৃতার্থ হইবে, সে কত কাল কামনা করিয়াছে। আর একজন বলিল, উহাকে লইবার জন্য কতজন আসিতেছে, দিলে এক্ষণেই লইয়া যায়, উহার মা দেয় না। আর একজন বলিল, না দিলেও তো হইবে না; একজনকে দিতেই তো হইবে, মেয়েছেলে হওয়া মিছা।
 
     সকল কথা শুনিয়া আমার মনে ভারি কষ্ট হইতে লাগিল। আমি একবারে অবাক্‌ হইয়া থাকিলাম। পরে আমি বাটীতে গিয়া মাকে বলিলাম, মা! আমাকে যদি কেহ চাহে, তবে কি তুমি আমাকে দিবে? মা বলিলেন, ষাট! তোমাকে কাহাকে দিব, এ কথা তোমাকে কে বলিয়াছে, কোথা শুনিলে, তোমাকে কেমন করিয়াই বা দিব। এই বলিয়া আমার মা চক্ষের জল মুছিতে মুছিতে ঘরের মধ্যে গেলেন। আমি দেখিলাম, আমার মা কাঁদিতেছেন। অমনি আমার প্রাণ উড়িয়া গেল, তখন আমি নিশ্চয়ই জানিলাম, আমাকে একজনকে দিবেন। তখন আমার হৃদয় এককালে বিদীর্ণ হইয়া যাইতে লাগিল, আমি ভাবিতে লাগিলাম, কি হইল, আমার মা আমাকে কোথা রাখিবেন।
 
     কথা আমার মনের মধ্যে এত যন্ত্রণা দিতে লাগিল যে, আমার মন একেবারে আচ্ছন্ন ও অবসন্ন হইয়া পড়িল, আর কিছুই ভাল লাগে না, আমি কাহারও সঙ্গে কথাও কহি না, আর কোন কাজও করি না, আমার খাইতেও ইচ্ছা হয় না, দিবা রাত্রি আমার কেবল কান্না আইসে। আমি এ কথা মনে ভাবিয়া সর্ব্বদা মনে মনে পরমেশ্বরকে ডাকিতাম। আর সকল সময়ই আমার চক্ষে জল পড়িত। এই প্রকার ভাবিতে ভাবিতে আমার শরীর এককালে শুকাইয়া গেল, এ সকল কথা আমার মনের মধ্যে থাকিত, ইহা আর কেহ জানিত না। কেবল পরমেশ্বর জানিতেন। আমি ইতিপূর্ব্বে শুনিয়াছিলাম সকল লোকেই বলিত যে, সকলেরি বিবাহ হইয়া থাকে, কিন্তু বিবাহের বিবরণ কি, তাহা আমি বিশেষ কিছু জানিতাম না; বিবাহ হয় এই মাত্র জানি। তখন সকল লোক আমাকে বলিতে লাগিল, তোমার বিবাহ হইবে। আমাকে যত্ন করিতে কেহ কখনও ক্রটি করেন নাই, তথাপি বিবাহ হইবে বলিয়া আরো যত্ন এবং স্নেহ করিতে লাগিলেন।
 
    তখন আমার মনে বেশ আহ্লাদ উপস্থিত হইল; বিবাহ হইবে, বাজনা আসিবে, সকলে হুলু দিবে, দেখিব। আবার ভয়ের সহিত কত প্রকার চিন্তা উপস্থিত হইতে লাগিল, তাহা বলা যায় না। এই প্রকার হইতে হইতে ক্রমে দিন দিন ব্যাপারের জিনিস-পত্র সমুদয়ের আয়োজন হইতে লাগিল। ক্রমেই সকল কুটুম্ব স্বজন বাটীতে আসিতে লাগিল। সকল দেখিয়া আমার অতিশয় ভয় হইতে লাগিল। আমি কাহারও সঙ্গে কথা কহি না, সকল দিবস কাঁদিয়াই কালযাপন করি। সকল লোক আমাকে কোলে লইয়া কত সান্ত্বনা করেন, তথাপি আমার মনের মধ্যে যে কি কষ্ট রহিয়াছে তাহা কিছুতেই যায় না।
 
    পরে ক্রমেই আমোদ বৃদ্ধি হইতে লাগিল। বিবাহের পূর্ব্ব দিবস অলঙ্কার, লাল সাড়ী, বাজনা প্রভৃতি দেখিয়া আমার ভারি আহ্লাদ হইল। তখন আর আমার সে সকল মনে নাই। আমি হাসিয়া হাসিয়া সকল দেখিয়া বেড়াইতে লাগিলাম। আমার আনন্দের আর সীমা থাকিল না। এ ব্যাপার সমাপন হইয়া গেলে পর দিবস প্রাতে সকল লোক আমার মায়ের নিকট জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল, ওরা কি আজি যাবে? তখন আমি ভাবিলাম, ঐ যাহারা আসিয়াছে, তাহারাই যাইবেপরে আমাদের বাহির বাটীতে নানা প্রকার বাজনার ধূমধাম আরম্ভ হইল।
 
    তখন ভাবিলাম, ঐ যাহারা আসিয়াছিল, এখন বুঝি তাহারাই যাইতেছে। এই ভাবিয়া আমি অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া মার সঙ্গে সঙ্গে বেড়াইতে লাগিলাম। অতি অল্পক্ষণের মধ্যে সকল লোক বাটীর মধ্যে আসিয়া জুটিল। দেখিলাম কতক লোক আহ্লাদে পরিপূর্ণ হইয়াছে, কতক লোক কাঁদিতেছে। উহা দেখিয়াই আমার প্রাণ চমকিয়া উঠিল। ক্রমে আমার দাদা, খুড়া, পিসি এবং মা প্রভৃতি সকলেই আমাকে কোলে লইয়া লইয়া কাঁদিতে লাগিলেন। এ সকলের কান্না দেখিয়া আমিও কাঁদিতে লাগিলাম। এ সময় আমি নিশ্চয় জানিলাম যে মা এখনি আমাকে দিবেন তখন আমি আমার মার কোলে গিয়া মাকে আঁটিয়া ধরিয়া থাকিলাম, আর মাকে বলিলাম, মা! তুমি আমাকে দিও না। আমার কথা শুনিয়া ও এই প্রকার ব্যবহার দেখিয়া স্থানের সকল লোক কাঁদিতে লাগিলেন এবং সকলে আমাকে সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। আমার মা আমাকে কোলে লইয়া অনেক মতে সান্ত্বনা করিয়া বলিলেন, মা আমার লক্ষ্মী, তুমি তো বেশ বুঝ, ভয় কি, আমাদের পরমেশ্বর আছেন, কেঁদ না, আবার এই কয়েক দিবস পরেই তোমাকে আনিব। সকলে শ্বশুরবাটীতে যায়, কেহতো তোমার মত কাঁদে না, তুমি কাঁদিয়া ব্যাকুল হইলে কেন? স্থির হইয়া কথা বলতখন আমার এত ভয় হইয়াছে যে, মুখে কথা বলিতে পারি না। তথাপি কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলাম, মা! পরমেশ্বর কি আমার সঙ্গে যাবেন? মা বলিলেন, হাঁ যাবেন বৈ কি, তিনি সঙ্গেই যাবেন, তিনি তোমার সঙ্গে সঙ্গেই থাকিবেন; তুমি আর কাঁদিও না। এই প্রকার বলিয়া অনেক সান্ত্বনা করিতে লাগিলেন। আমার ভয় এবং কান্না কিছুতে নিবৃত্ত হইল না। ক্রমেই আরো বৃদ্ধি হইতে লাগিল।
 
    তখন অনেক কষ্টে সকলে আমার মায়ের কোল হইতে আমাকে আনিলেন। সময় আমার কি ভয়ানক কষ্ট হইল! সে কথা মনে পড়িলে এখনও দুঃখ হয়। বাস্তবিক আপনার মা ও আপনার সকলকে ছাড়িয়া ভিন্ন দেশে গিয়া বাস এবং যাবজ্জীবন তাহাদিগের অধীনতা স্বীকার, আপনার মাতাপিতা কেহ নহেন - এটি কি সামান্য দুঃখের বিষয়! কিন্তু ইহা ঈশ্বরাধীন কর্ম্ম, এইজন্য ইহা প্রশংসার যোগ্য বটে।
 
    আমাকে যে কোলে লইতে লাগিল, আমি তাহকেই দুই হাতে ধরিয়া থাকিতে লাগিলাম, আর কাঁদিতে লাগিলাম। আমাকে দেখিয়া আবালবৃদ্ধ সকলে কাঁদিতে লাগিল, এই প্রকারে সকলে আমাকে অনেক যত্নে আনিয়া দ্বিতীয় পাল্কীতে না দিয়া এক পাল্কীর মধ্যেই উঠাইয়া দিলেন। আমাকে পাল্কীর মধ্যে দিবামাত্রই বেহারারা লইয়া চলিল; আমার নিকট আমার আত্মবন্ধু কেহই ছিল না, আমি এককালে বিপদ সাগরে পড়িলাম, আমি আর কোন উপায় না দেখিয়া মনের মধ্যে এই মাত্র বলিতে লাগিলাম, পরমেশ্বর! তুমি আমার কাছে থাক। মনে মনে এই বলিয়া কাঁদিতে লাগিলাম। তখন আমার মনের ভাব কি বিষম হইয়াছিল! যখন দুর্গোসবে কি শ্যামাপুজায় পাঁঠা বলি দিতে লইয়া যায়, সে সময়ে সেই পাঁঠা যেমন প্রাণের আশা ত্যাগ করিয়া হতজ্ঞান হইয়া মা মা মা বলিয়া ডাকিতে থাকে, আমার মনের ভাবও তখন ঠিক সেই প্রকার হইয়াছিল। আমি আমার পরিবারগণকে না দেখিয়া, অত্যন্ত ব্যাকুল হইয়া মা মা বলিয়া কাঁদিতে লাগিলাম, আর মনের মধ্যে একান্তমনে কেবল পরমেশ্বরকে ডাকিতে লাগিলাম। আর ভাবিতে লাগিলাম, আমার মা বলিয়াছেন, তোমার ভয় হইলে পরমেশ্বরকে ডাকিও।
 
     কথা মনে ভাবিয়া ভাবিয়া কাঁদিতে লাগিলাম, এই প্রকার কাঁদিতে কাঁদিতে আমার গলা শুকাইয়া গেল এবং ক্রন্দন-শক্তিও রহিত হইয়া গেল।
(ক্রমশঃ ... চতুর্থ রচনা পরের পর্বে) 


একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ