অনুবাদ-চর্চার বিকাশধারা
উনিশ শতকের বাংলাদেশের ভাবজীবনে যে-অভিনব চিন্তাতরঙ্গের আলোড়ন দেখা গিয়েছিল তা সাধারণভাবে রেনেসাঁস বা নবচেতনা নামে চিহ্নিত। ইংরেজ-অধিকার এই দেশের গ্রামকেন্দ্রিক সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করল এবং তার ফলে পল্লীসংস্কৃতি শুকিয়ে গেল। ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসনের সহায়ক হল নতুন গড়ে ওঠা একটি ধনবান ও একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তৎকালীন পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশের (মূলত, ইংলন্ডেরই) সংস্কৃতি ছিল তাদের কাছে অনুকরণীয়, এর পাশাপাশি তারা বিজয়ী শাসকশ্রেণীর ব্যবহারিক সংস্কৃতিকেও অনুসরণ করতে থাকল। কাজেই দেখা গেল নবচেতনার কালে প্রাচীন সংস্কৃতির অবক্ষয়, ভাঙনের মধ্যে শূন্যস্থান পূরণের জন্য শাসকশ্রেণীর সংস্কৃতিকে দুর্বলভাবে অনুসরণ বা অনুকরণ করাই হল প্রধান বৈশিষ্ট্য ।
এই অনুকরণের যা-যা উপজীব্য ছিল, তাদের মধ্যে আধুনিক
যুগের বিশ্বসংস্কৃতির আদর্শ ও দেখা যায়। অন্যভাবেও এই অনুকৃত সাহিত্য-সংস্কৃতির
তাৎপর্য লক্ষ করা যায়। ইংরেজ শাসনের প্রতিষ্ঠা একদিকে যেমন বাঙালির রাজনৈতিক ও
অর্থনৈতিক ভিতকে নাড়িয়ে দিল, তেমনি
আবার সেই ধ্বংসের মধ্যে দিয়েই ইংরেজদের বিরুদ্ধে নতুন বিরোধের বীজও লক্ষ করা গেল।
যে নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠল, তারাই আবার পাশ্চাত্য
শিক্ষাদীক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে
অস্ত্র হিসাবে প্রয়োগ করতে উদ্যত হয়েছিল। একারণে বিজয়ী সংস্কৃতির আদর্শ গ্রহণ
করতে তারা বাধ্য হয়েছিল। এইসময় সেকালের উন্নত ও প্রগতিশীল মনীষীরা, যেমন রামমোহন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর,
মধুসূদন, বঙ্কিমচন্দ্র অক্ষয়কুমার
প্রমুখ ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তার চেয়েছিলেন । আবার সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশীয় কৃষ্টি-কলা- সাহিত্য-সংস্কৃতিরও সুপ্রতিষ্ঠ অবস্থানও তাঁদের বিশেষভাবে অভীপ্সিত ছিল। উনিশ শতকের প্রথম অর্ধে
শিক্ষা ও সংস্কৃতির আন্দোলনে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অনুসরণ দেখা দিয়েছিল আর
পরবর্তী অর্ধশতাব্দীতে পাশ্চাত্যের সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুপ্রেরণায় তৈরি হওয়া
নতুন বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সাহায্যে বিদেশি শক্তি ও
সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল। এই নতুন সংস্কৃতির জন্য পাশ্চাত্য
সাহিত্যের ভাবরূপের অনুপ্রেরণায় নতুন একটি সাহিত্যধারা গড়ে উঠল। আর তারই অনুষঙ্গে অনুবাদেরও ব্যাপক প্রয়োজন দেখা দিল। আধুনিক যুগেও বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও
সাহিত্যিকরা গভীরভাবে পাশ্চাত্যের সাহিত্যকে যেভাবে অধ্যয়ন তা প্রকাশ পেয়েছে।
বিলিতি নাটকের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভাবানুবাদ করেন হরচন্দ্র ঘোষ ১৮৫৩
রিস্টাব্দে। শেক্সপিয়রের ‘মার্চেন্ট অব ও ভেনিস’-এর ভাবানুবাদ করেন তিনি ‘ভানুমতী চিন্তবিলাস’
নাম দিয়ে। ১৮৬৪-তে তিনি আবার শেক্সপিয়রের অনুবাদে প্রবৃত্ত হন। ‘রোমিও অ্যাণ্ড জুলিয়েট’ তাঁর
হাতে পরিণত হয় ‘চারুমুখ চিত্তহরা’-তে।
মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’-এ পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষ করা যায়। তিনি হোমারের ‘ইলিয়াড’ মহাকাব্যের আংশিক অনুবাদ করেন ‘হেক্টর বধ’ (১৮৭১) নামে। প্রাক-রবীন্দ্রযুগে অনুবাদের ক্ষেত্রে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৮৬৮ খিস্টাব্দে তিনি শেক্সপিয়রের ‘টেম্পেস্ট’ নাটকের অনুবাদ করেন ‘নলিনী বসন্ত’ নাম দিয়ে। এরপরে ১৩০১ বঙ্গাব্দে তিনি শেক্সপিয়রের ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ নাটকের অনুসরণে ‘রোমিও জুলিয়েত’ নাটক রচনা করেন। এছাড়া তিনি কয়েকটি ইংরেজি কবিতাও অনুবাদ করেছিলেন। যেমন- লংফেলোর রচিত ‘সাঙ অব লাইফ’-এর অনুবাদ ‘জীবন সঙ্গীত’, আলেকজান্ডার পোপের ‘এলয়সা টু আবেলার্ড’-এর প্রেরণায় ‘মদন পারিজাত’, শেলির ‘দ্য স্কাইলার্ক’-এর অনুসরণে ‘ভরতপক্ষীর প্রতি’ (চাতকপক্ষীর প্রতি) ইত্যাদি রচনা করেছিলেন। ‘জীবন সঙ্গীত’ কবিতাটি পুরো মূলানুগ, তবে ‘মদন পারিজাত'-এ স্থানে স্থানে মূলানুগত্য লক্ষ করা যায়। ‘ভরতপক্ষীর প্রতি’, যা পরে হয়েছিল ‘চাতকপক্ষীর প্রতি’ কবিতাটিতে কবি মূল রচনাকে প্রায় পুরোপুরি-ই অনুবাদ করতে চেয়েছেন।
হেমচন্দ্রের পরবর্তীকালে নবীনচন্দ্র সেন শেক্সপিয়রের ‘এ মিড সামার নাইট'স ড্রিম’-এর
মর্মানুবাদ করেছিলেন। আরো পরবর্তীকালে অক্ষয়কুমার দত্ত কিছু অনুবাদ করেছিলেন।
যেমন- তাঁর ‘গেছে’ কবিতাটি ব্রাউনিঙ-এর একটি কবিতার আংশিক ভাবানুবাদ :
“এই পথ দিয়ে গেছে - এখনো যেতেছে দেখা
শত শুভ্র তৃণ ফুলে চরণ - অলখিত রেখা;
এই পথ দিয়ে গেছে ছিড়ে পাতা তুলে ফুল?”
“This
path so soft to pace shall lead
Thro’
the magic of to herself indeed?”
এরপরে উল্লেখ করা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের
অনুবাদচর্চার প্রসঙ্গে। পাশ্চাত্যের বহু কবিতার অনুবাদ তিনি করেছিলেন। দীর্ঘ আট
বছর ধরে তাঁর এই অনুবাদচর্চা প্রসারিত ছিল। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে গৃহশিক্ষক জ্ঞানচন্দ্র
ভট্টাচার্যের অনুরোধে কবি ‘ম্যাকবেথ’ নাটকের অনুবাদ করেন। তবে সেটি আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ইচ্ছামতো
কবি এখানে শব্দের পরিবর্তন করেছেন। যেমন- “The rumpfed ranyon cries”-এর বাংলা করা হয়েছে “পোড়ারমুখী বোল্লে রেগে”। তবে ডাইনিদের সংলাপের মূল ভাব অনুবাদের ভাষায় আশ্চর্য রকমভাবে
জীবন্ত হয়ে উঠেছে।
দ্বিতীয়ত,
গৌড়ের সুলতানেরা সিংহাসনে সুস্থির হয়ে রাজসভার পণ্ডিতদের ডেকে তাঁদের কাছে হিন্দুর
শাস্ত্রগ্রন্থাদি শোনার যখন আগ্রহ দেখান, তখন
থেকেই এসব গ্রন্থ অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাতার-তুরকি-খোরাসানি-পাঠান-মুসলমানরা
প্রথম দিকে দুরত্ব বজায় রেখে এদেশকে শাসন করলেও ধীরে ধীরে তারা এদেশকে ভালোবেসে, এদেশের ভাষা শিখে, এদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হলেন। অনেক সুলতান-ই হিন্দু
পণ্ডিতদের কাছ থেকে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প শুনতে চাইতেন
এবং অনেক সময় তারা সেগুলিকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতেও
উদ্বুদ্ধ করতেন। বাংলা সাহিত্যের আদি ইতিহাসকার ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’ গ্রন্থে
বলেছিলেন, -
“মুসলমান, ইরান, তুরাণ প্রভৃতি যে স্থান হইতেই আসুন না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙ্গালী হইয়া পড়িলেন। তাঁহারা হিন্দুপ্রজামণ্ডলী পরিবৃত হইয়া বাস করিতে লাগিলেন। মসজিদের পার্শ্বে দেবমন্দিরের ঘণ্টা বাজিতে লাগিল। মহরম, ঈদ, সবেবরাৎ প্রভৃতির পার্শ্বে দুর্গোৎসব, রাস, দোলোৎসব প্রভৃতি চলিতে লাগিল। রামায়ণ ও মহাভারতের অপূর্ব প্রভাব মুসলমান সম্রাটগণ লক্ষ্য করিলেন। এদিকে দীর্ঘকাল এদেশে বাসনিবন্ধন বাঙ্গালা তাঁহাদের একরূপ মাতৃভাষা হইয়া পড়িল। হিন্দুদের ধর্ম, আচার ব্যবহার প্রভৃতি জানিবার জন্য তাহাদের পরম কৌতুহল হইল। গৌড়ের সম্রাটগণের প্রবর্তনায় হিন্দু শাস্ত্র গ্রন্থের অনুবাদ আরম্ভ হইল।"
মালাধর বসু তাঁর গ্রন্থে
সুলতান বারবক শাহের কথা বলেছেন। আবার কবীন্দ্র পরমেশ্বর ও
শ্রীকর নন্দী ছুটি খাঁর সভাকবি ছিলেন। অবশ্য এঁরা দুজনেই
মুসলমান সুলতানের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ আনুকুল্য পেয়েছিলেন। এই সমস্ত মুসলমান
নৃপতিরা মহাভারতের কাহিনীর প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা
সাহিত্যের এই যুগকে হুসেনশাহী যুগ নামে অভিহিত করেছেন।
তবে বাংলাভাষায় সংস্কৃত বহু গ্রন্থের অনুবাদ হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এর ফলে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধিশালিনীও হয়েছে এবং বাংলা ভাষার সম্পদও বৃদ্ধি পেয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রাজা রামমোহন রায় কয়েকটি উপনিষদ্ ও বেদান্তের অনুবাদ করেছিলেন। রমেশচন্দ্র দত্ত ঋগ্বেদের অনুবাদ করেছিলেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী করেছিলেন ঐতরেয় ব্রাহ্মণের অনুবাদ। নবীনচন্দ্র দাস রঘুবংশের পদ্যানুবাদ করেছিলেন। এর পাশাপাশি কালিদাসের প্রতিটি কাব্যের অনুবাদ হয়েছে। এছাড়া পাণিনির ব্যাকরণ, সিদ্ধান্ত কৌমুদী, পতঞ্জলির মহাভাষ্য, অমরকোষ, সাহিত্যদর্পণ, মনুসংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা ইত্যাদি গ্রন্থও অনুবাদ হয়েছে।
ইংরেজি এবং সংস্কৃত সাহিত্যের পাশাপাশি পালি ও প্রাকৃত বহু
গ্রন্থের অনুবাদ বাংলা ভাষায় হয়েছে। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কল্পসূত্র, জগৎরাম ভট্টাচার্যের দশবৈকালিক সূত্র, রাধাগোবিন্দ বসাকের গাথাসপ্তশতীর অনুবাদ সর্বজনবিদিত। ঈশানচন্দ্র ঘোষের
জাতকের অনুবাদ তো বিশেষভাবেই উল্লেখযোগ্য ।
0 মন্তব্যসমূহ