Header Ads Widget

WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা ** WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা **

ticker

6/recent/ticker-posts

অনুবাদ-চর্চার বিকাশধারা

 অনুবাদ-চর্চার বিকাশধারা 



 

    উনিশ শতকের বাংলাদেশের ভাবজীবনে যে-অভিনব চিন্তাতরঙ্গের আলোড়ন দেখা গিয়েছিল তা সাধারণভাবে রেনেসাঁস বা নবচেতনা নামে চিহ্নিত। ইংরেজ-অধিকার এই দেশের গ্রামকেন্দ্রিক সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোর অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ধ্বংস করল এবং তার ফলে পল্লীসংস্কৃতি শুকিয়ে গেল। ইংরেজের ঔপনিবেশিক শাসনের সহায়ক হল নতুন গড়ে ওঠা একটি ধনবান ও একটি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী। তৎকালীন পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশের (মূলত, ইংলন্ডেরই) সংস্কৃতি ছিল তাদের কাছে অনুকরণীয়, এর পাশাপাশি তারা বিজয়ী শাসকশ্রেণীর ব্যবহারিক সংস্কৃতিকেও অনুসরণ করতে থাকল। কাজেই দেখা গেল নবচেতনার কালে প্রাচীন সংস্কৃতির অবক্ষয়, ভাঙনের মধ্যে শূন্যস্থান পূরণের জন্য শাসকশ্রেণীর সংস্কৃতিকে দুর্বলভাবে অনুসরণ বা অনুকরণ করাই হল প্রধান বৈশিষ্ট্য ।

    এই অনুকরণের যা-যা উপজীব্য ছিল, তাদের মধ্যে আধুনিক যুগের বিশ্বসংস্কৃতির আদর্শ ও দেখা যায়। অন্যভাবেও এই অনুকৃত সাহিত্য-সংস্কৃতির তাৎপর্য লক্ষ করা যায়। ইংরেজ শাসনের প্রতিষ্ঠা একদিকে যেমন বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ভিকে নাড়িয়ে দিল, তেমনি আবার সেই ধ্বংসের মধ্যে দিয়েই ইংরেজদের বিরুদ্ধে নতুন বিরোধের বীজও লক্ষ করা গেল। যে নতুন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে উঠল, তারাই আবার পাশ্চাত্য শিক্ষাদীক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নতুন শিক্ষা ও সংস্কৃতিকে অস্ত্র হিসাবে প্রয়োগ করতে উদ্যত হয়েছিল। একারণে বিজয়ী সংস্কৃতির আদর্শ গ্রহণ করতে তারা বাধ্য হয়েছিল। এইসময় সেকালের উন্নত ও প্রগতিশীল মনীষীরা, যেমন রামমোহন, ডিরোজিও, বিদ্যাসাগর, মধুসূদন, ঙ্কিমচন্দ্র অক্ষয়কুমার প্রমুখ ইংরেজি শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিস্তার চেয়েছিলেন । আবার সঙ্গে সঙ্গে স্বদেশীয় কৃষ্টি-কলা- সাহিত্য-সংস্কৃতিরও সুপ্রতিষ্ঠ অবস্থানও তাঁদের বিশেষভাবে অভীপ্সিত ছিল। উনিশ শতকের প্রথম অর্ধে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আন্দোলনে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের অনুসরণ দেখা দিয়েছিল আর পরবর্তী অর্ধশতাব্দীতে পাশ্চাত্যের সাহিত্য-সংস্কৃতির অনুপ্রেরণায় তৈরি হওয়া নতুন বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির সাহায্যে বিদেশি শক্তি ও সংস্কৃতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হয়েছিল। এই নতুন সংস্কৃতির জন্য পাশ্চাত্য সাহিত্যের ভাবরূপের অনুপ্রেরণায় নতুন একটি সাহিত্যধারা গড়ে উঠল। আর তারই অনুষঙ্গে অনুবাদেরও ব্যাপক প্রয়োজন দেখা দিল। আধুনিক যুগেও বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিকরা গভীরভাবে পাশ্চাত্যের সাহিত্যকে যেভাবে অধ্যয়ন তা প্রকাশ পেয়েছে।

     ইংরেজ সিভিলিয়ানদের বাংলা শেখানোর জন্য ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রতিষ্ঠা হয়। তারপর মূলত ডেভিড হেয়ারের উদ্যোগে সর্বসাধারণের জন্য হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা হল। এই সময়ে পাঠ্য গ্রন্থ প্রণয়নে অনুবাদই প্রধান অবলম্বন ছিল। সংস্কৃত, ফারসি ও ইংরেজি এই তিন ভাষা থেকেই অনুবাদ ও গ্রন্থরচনা শুরু হয় এই সময় থেকে।

     ১৮০০ সালে উইলিয়াম কেরী রচিত “মঙ্গল সমাচার মাতিউর রচিত গস্পেল অব সেন্ট ম্যাথু- ইংরেজি থেকে বাংলায় প্রথম অনূদিত গ্রন্থ। এরপরে ১৮০৩-তে ওরিয়েন্টাল ফেবুলিস্টনামে ঈশপের গল্প কয়েকটি ভারতীয় ভাষায় রচিত হয়। বাংলা অনুবাদটি করেছিলেন তারিণীচরণ মিত্র। ফোর্ট উইলিয়মের অন্যতম সেনানী সি. মংকটন ১৮০৯ সালে শেক্সপিয়রের দ্য টেম্পেস্টনাটকের অনুবাদ করেছিলেন। ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছাত্র জে. সার্জেন্ট প্রথম বাংলায় পাশ্চাত্য ক্লাসিক কাব্য অনুবাদ করেছিলেন। ভার্জিলের ঈনিডকাব্যের প্রথম সর্গ তিনি ১৮০৫ খ্রিস্টাব্দে অনুবাদ করেন। এরপরে গিরিশচন্দ্র বসু ইলিয়াড-এর প্রথম সর্গ এবং মিলটনের প্যারাডাইস্‌ লস্ট’-এর অনুবাদ করেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় হোমারের কাব্য ভেক মুষিকের যুদ্ধ নামে অনুবাদ করেন। এই সময় হরিমোহন গুপ্ত পার্নেলের দ্য হারমিটকাব্যের অনুবাদ করেন। অনুবাদটির নাম ‘সন্ন্যাসীর উপাখ্যান। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে যদুনাথ চট্টোপাধ্যায় গোল্ডস্মিথ-এর ডেজার্টেড ভিলেজ’-এর অনুবাদ করেন পরিত্যক্ত গ্রামনামে। টেনিসনের ইন মেমোরিয়ামকবিতার অনুবাদ করেন রাজকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায় মিত্রবিলাপ ও অন্যান্য কবিতাবলী এই নামে ১৮৬৯ খ্রিস্টাব্দে । ১৮৭৫-তে ওয়াল্টার স্কটের দ্য ল্যে অব দ্য লাস্ট মিনস্ট্রেল-এর অনুবাদ করেন রাখালদাস সেনগুপ্ত শেষ বন্দীর গান নাম দিয়ে।

     এরই পাশাপাশি আধুনিক কালের বাংলা সাহিত্যের প্রথম যুগ থেকেই গদ্য, উপন্যাস, ছোটগল্প এবং নাটক রচনাতেও অনুবাদের প্রয়োগ লক্ষ করা যায়। বাংলা ভাষার প্রথম তিহাসিক উপন্যাস, ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের ‘ঐতিহাসিক উপন্যাস অনুবাদমূলক। ১৮৭৬ সালে জোনাথন সুইফটের-এর গালিভারস ট্রাভেল্স'-এর অপূর্ব দেশভ্রমণনাম দিয়ে উপেন্দ্রনাথ মিত্র অনুবাদ করেন। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে অদ্ভুত দিগ্বিজয়’ (প্রথম খণ্ড) নাম দিয়ে বিখ্যাত স্পেনীয় লেখক সার্ভেস্তিসের দোন কীহোতে’ (ডন কুইক্জোট) এবং মন্মথ মনোরমা’ (প্রথম খণ্ড) নাম দিয়ে হেনরি ফিলডিঙের আমেলিয়া’ - এই গ্রন্থদুটির অনুবাদ করেন বিপিনবিহারী চক্রবর্তী। সেকালের ইংল্যান্ডের জনপ্রিয় রেনল্ডসের মিস্ট্রিজ অব দ্য কোর্ট অব লন্ডন’-এর কিছু অনুবাদ প্রকাশিত হয়। সেই সময়ে কথাসাহিত্যের অনুবাদে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলেন কৃষ্ণকমল ভটাচার্য। তিনি ফরাসি ভাষা থেকে বার্নাদ্যা দ্য সী পিয়ের-এর পোল এৎ ভির্জিনি’-পৌলবর্জিনী' নামে অনুবাদ করেছিলেন। এই অনুবাদের কথা রবীন্দ্রনাথও উল্লেখ করেছিলেন। তাঁর বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক ছোটগল্প প্রম চৌধুরীর ফুলজানিফরাসি লেখক প্রস্পার মেরিমির গল্প থেকে অনুবাদ করা হয়েছে।

    বিলিতি নাটকের প্রথম পূর্ণাঙ্গ ভাবানুবাদ করেন হরচন্দ্র ঘোষ ১৮৫৩ রিস্টাব্দে। শেক্সপিয়রের ‘মার্চেন্ট অব ও ভেনিস’-এর ভাবানুবাদ করেন তিনি ভানুমতী চিন্তবিলাসনাম দিয়ে। ১৮৬৪-তে তিনি আবার শেক্সপিয়রের অনুবাদে প্রবৃত্ত হন। রোমিও অ্যাণ্ড জুলিয়েট’ তাঁর হাতে পরিণত হয় চারুমুখ চিত্তহরা’-তে।

    মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধ কাব্য-এ পাশ্চাত্য প্রভাব লক্ষ করা যায়। তিনি হোমারের ইলিয়াড’ মহাকাব্যের আংশিক অনুবাদ করেন হেক্টর বধ (৮৭১) নামে। প্রাক-রবীন্দ্রযুগে অনুবাদের ক্ষেত্রে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। ১৮৬৮ খিস্টাব্দে তিনি শেক্সপিয়রের টেম্পেস্টনাটকের অনুবাদ করেন নলিনী বসন্ত’ নাম দিয়ে। এরপরে ১৩০১ বঙ্গাব্দে তিনি শেক্সপিয়রের রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েটনাটকের অনুসরণে রোমিও জুলিয়েতনাটক রচনা করেন। এছাড়া তিনি কয়েকটি ইংরেজি কবিতাও অনুবাদ করেছিলেন। যেমন- লংফেলোর রচিত সা অব লাইফ’-এর অনুবাদ জীবন সঙ্গীত’, আলেকজান্ডার পোপের এলয়সা টু আবেলার্ড-এর প্রেরণায় মদন পারিজাত’, শেলির দ্য স্কাইলার্ক-এর অনুসরণে ভরতপক্ষীর প্রতি’ (চাতকপক্ষীর প্রতি) ইত্যাদি রচনা করেছিলেন। জীবন সঙ্গীত কবিতাটি পুরো মূলানুগ, তবে মদন পারিজাত'-এ স্থানে স্থানে মূলানুগত্য লক্ষ করা যায়। ভরতপক্ষীর প্রতি’, যা পরে হয়েছিল চাতকপক্ষীর প্রতিকবিতাটিতে কবি মূল রচনাকে প্রায় পুরোপুরি-ই অনুবাদ করতে চেয়েছেন।

    হেমচন্দ্রের পরবর্তীকালে নবীনচন্দ্র সেন শেক্সপিয়রের এ মিড সামার নাইট'ড্রিম’-এর মর্মানুবাদ করেছিলেন। আরো পরবর্তীকালে অক্ষয়কুমার দত্ত কিছু অনুবাদ করেছিলেন। যেমন- তাঁর গেছেকবিতাটি ব্রাউনি-এর একটি কবিতার আংশিক ভাবানুবাদ :

এই পথ দিয়ে গেছে - এখনো যেতেছে দেখা

শত শুভ্র তৃণ ফুলে চরণ - অলখিত রেখা;

এই পথ দিয়ে গেছে ছিড়ে পাতা তুলে ফুল?”

 

“This path so soft to pace shall lead

Thro’ the magic of to herself indeed?”

 

    এরপরে উল্লেখ করা যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনুবাদচর্চার প্রসঙ্গে। পাশ্চাত্যের বহু কবিতার অনুবাদ তিনি করেছিলেন। দীর্ঘ আট বছর ধরে তাঁর এই অনুবাদচর্চা প্রসারিত ছিল। ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে গৃহশিক্ষক জ্ঞানচন্দ্র ভট্টাচার্যের অনুরোধে কবি ম্যাকবেথনাটকের অনুবাদ করেন। তবে সেটি আক্ষরিক অনুবাদ নয়, ইচ্ছামতো কবি এখানে শব্দের পরিবর্তন করেছেন। যেমন- “The rumpfed ranyon cries”-এর বাংলা করা হয়েছে পোড়ারমুখী বোল্লে রেগে”। তবে ডাইনিদের সংলাপের মূল ভাব অনুবাদের ভাষায় আশ্চর্য রকমভাবে জীবন্ত হয়ে উঠেছে।

     এর পাশাপাশি তিনি ম্যুর, বায়রন, বার্নস প্রভৃতি কবির বিভিন্ন কবিতা অনুবাদ করেছেন। যেমন-বিচ্ছেদকবিতাটি ম্যুরের ‘As Slow Our Ship’-এর অনুবাদ। বিদায় চুম্বন কবিতাটি বার্নসের ‘As Fond Kids’ কবিতার অনুবাদ। বার্নসের ‘O Philly, Happy be that day’ কবিতার অনুবাদ করে রবীন্দ্রনাথ তার নাম দিয়েছিলেন ললিত নলিনী (কৃষকের প্রেমালাপ)।

     অনুবাদচর্চায় রবীন্দ্রনাথের উত্তরসূরী হিসেবে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের অনুবাদ প্রধান কাব্যগ্রন্থ আর্যগাথা’ (১ম) প্রকাশিত হয় ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে। দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর পূর্ববর্তী বাংলা সাহিত্যে প্রচুর অনুবাদ হয়েছিল। তাঁর অনুবাদের প্রাথমিক প্রেরণা ছিল ইংরেজি সাহিত্য আস্বাদন এবং শিক্ষিত ও অল্প শিক্ষিতদের মধ্যে পাশ্চাত্য সাহিত্যরস পৌছে দেওয়া।

     দ্বিজেন্দ্রলালের পরবর্তীকালে সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত - শেলি, কীটস্‌, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, সুইনবার্ন, ব্রাউনিং, এডগার অ্যালান প্যো, ওয়ালট হুইটম্যান প্রমুখ পাশ্চাত্যের সাহিত্যিকদের লেখার পাশাপাশি, সংস্কৃত, ফরাসি, চিনা, জাপানি, তামিল ইত্যাদি ভাষা থেকে এবং ডিরোজিও, তরু দত্ত - প্রমুখ এদেশি ইংরেজি কবিদের লেখারও কিছু অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর কয়েকটি অনুবাদ সংকলন হল : তীর্থসলিল’, ‘তীর্থরেণুএবং মণিমঞ্জুষা

     এতক্ষণ আমরা পাশ্চাত্য সাহিত্যের অনুবাদ সম্পর্কে আলোচনা করলাম। এবার আসি সংস্কৃত সাহিত্যের অনুবাদ প্রসঙ্গে। উনিশ শতক নবজাগরণের যুগ। এযুগে শিক্ষিত বাঙালিরা পাশ্চাত্য সাহিত্যের সংস্পর্শে এসে বিদেশি ভাবধারাকে গ্রহণের পাশাপাশি নিজের দেশের প্রাচীন সাহিত্যের গরিমা আবিষ্কারও করতে চেয়েছেন এবং এর ফলেই প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের অনুবাদচর্চা শুরু হয়েছে।

     প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে অনুবাদ সাহিত্য একটি বিশিষ্ট শাখা। সংস্কৃত ভাষায় রচিত রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত ইত্যাদির বঙ্গানুবাদকে প্রাচীন বাংলা অনুবাদ সাহিত্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই অনুবাদ সাহিত্যের উদ্ভবের মূলে কিছু কারণ উল্লেখিত হয়ে থাকে। প্রথমত, তুর্কি আক্রমণের ফলে যখন প্রাচীন সংস্কৃতি বিনষ্ট হবার উপক্রম দেখা যায়, তখন জনসাধারণকে উদ্দীপিত করার জন্য সংস্কৃত থেকে মহাকাব্য, পুরাণ ইত্যাদি গ্রন্থের অনুবাদ শুরু হল। সমাজ ও সংস্কৃতি এবং ধর্মের উপর রাজশক্তির আক্রমণে, একসময় ব্রাহ্মণ্য বিধিশাসিত হিন্দুসমাজ চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। খ্রিস্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে তুর্কি আক্রমণজনিত উত্তালতা কিছুটা শান্তরূপ ধারণ করলে সমাজে আবার শিল্প-সংস্কৃতির জোয়ার এলো। অনুবাদ-সাহিত্যের প্রথম গ্রন্থগুলি, তুর্কি বিজয়ের প্রথম দু-শতকের অনিশ্চয়তা, অস্থিরতার অবসানের পরে এবং চৈতন্য-প্রভাব বিস্তারিত হবার আগে রচিত হয়েছিল। তুর্কি-বিজয়ের ফলে পরাজিত হিন্দুশক্তি ধর্মীয় সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের সাহায্যে আত্মরক্ষা করতে চেয়েছিল। এই প্রতিরোধের মূল কথা ছিল উপরতলার ব্রাহ্মণ্য-বৈদিক-স্মার্ত-পৌরাণিক ধারার সঙ্গে লোকজীবনে প্রচলিত অব্রাম্মণ্য-অবৈদিক-অস্মার্ত-অপৌরাণিক ধারার মিশ্রণ। এই মিশ্রণের ফলে যে নতুন ভাবধারা গড়ে উঠেছিল, তার সামনে পৌরাণিক আদর্শ তুলে ধরার প্রয়োজন ছিল। বাংলা ভাষা সংস্কৃতের উত্তরাধিকারী । তাই সংস্কৃত ভাষার প্রাচীন আখ্যায়িকাগুলি উত্তরাধিকার সূত্রেই প্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু সংস্কৃত ভাষায় রচিত গ্রন্থের প্রচার ছিল সীমাবদ্ধ। হিন্দু সমাজের সব শ্রেণীর মধ্যেই নিজের ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য পৌরাণিক সাহিত্য- বিশেষ করে রামায়ণ, মহাভারতের প্রচারের প্রয়োজন ছিল। তাই অনুবাদের মধ্যে দিয়ে রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত যা কিনা সংস্কৃত ভাষায় রচিত হয়েছিল তা জনসাধারণের জীবনের সঙ্গে একদম জড়িয়ে যাবার সুযোগ পেল।

    দ্বিতীয়ত, গৌড়ের সুলতানেরা সিংহাসনে সুস্থির হয়ে রাজসভার পণ্ডিতদের ডেকে তাঁদের কাছে হিন্দুর শাস্ত্রগ্রন্থাদি শোনার যখন আগ্রহ দেখান, তখন থেকেই এসব গ্রন্থ অনুবাদের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাতার-তুরকি-খোরাসানি-পাঠান-মুসলমানরা প্রথম দিকে দুরত্ব বজায় রেখে এদেশকে শাসন করলেও ধীরে ধীরে তারা এদেশকে ভালোবেসে, এদেশের ভাষা শিখে, এদেশের সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হলেন। অনেক সুলতান-ই হিন্দু পণ্ডিতদের কাছ থেকে রামায়ণ, মহাভারতের গল্প শুনতে চাইতেন এবং অনেক সময় তারা সেগুলিকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করতেও উদ্বুদ্ধ করতেন। বাংলা সাহিত্যের আদি ইতিহাসকার ডঃ দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর ঙ্গভাষা ও সাহিত্য গ্রন্থে বলেছিলেন, -

মুসলমান, ইরান, তুরাণ প্রভৃতি যে স্থান হইতেই আসুন না কেন, এদেশে আসিয়া সম্পূর্ণরূপে বাঙ্গালী হইয়া পড়িলেন। তাঁহারা হিন্দুপ্রজামণ্ডলী পরিবৃত হইয়া বাস করিতে লাগিলেন। মসজিদের পার্শ্বে দেবমন্দিরের ঘণ্টা বাজিতে লাগিলমহরম, ঈদ, সবেবরাৎ প্রভৃতির পার্শ্বে দুর্গোৎস, রাস, দোলোৎসব প্রভৃতি চলিতে লাগিল। রামায়ণ ও মহাভারতের অপূর্ব প্রভাব মুসলমান সম্রাটগণ লক্ষ্য করিলেন। এদিকে দীর্ঘকাল এদেশে বাসনিবন্ধন বাঙ্গালা তাঁহাদের একরূপ মাতৃভাষা হইয়া পড়িল। হিন্দুদের ধর্ম, আচার ব্যবহার প্রভৃতি জানিবার জন্য তাহাদের পরম কৌতুহল হইল গৌড়ের ম্রাটগণের প্রবর্তনায় হিন্দু শাস্ত্র গ্রন্থের অনুবাদ আরম্ভ হইল।"

    মালাধর বসু তাঁর গ্রন্থে সুলতান বারবক শাহের কথা বলেছেন। আবার বীন্দ্র পরমেশ্বর ও শ্রীকর নন্দী ছুটি খাঁর সভাকবি ছিলেন। অবশ্য এঁরা দুজনেই মুসলমান সুলতানের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ আনুকুল্য পেয়েছিলেন। এই সমস্ত মুসলমান নৃপতিরা মহাভারতের কাহিনীর প্রতিই বেশি আকৃষ্ট হয়েছিলেন। দীনেশচন্দ্র সেন বাংলা সাহিত্যের এই যুগকে হুসেনশাহী যুগ নামে অভিহিত করেছেন।

     তৃতীয়ত, রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থের কাহিনি কবিদের মুগ্ধ করেছিল এবং তারা এগুলি অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু তারা যে শুধু সুলতান বা নৃপতিদের আনুকুল্যের দ্বারা প্রভাবিত হয়েই কাব্য রচনা করেছিলেন তা নয়, কাব্যগুলির সাহিত্যগুণে মুগ্ধ হয়েও সেগুলি অনুবাদে আগ্রহী হয়েছিলেন।

     প্রথমযুগে রচিত এইসব অনুদিত গ্রন্থের কিছু কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। যেমন- সেই সময় বাঙালি কবিদের সামনে কালিদাসের বিখ্যাত সব কাব্য, নানারকম পুরাণ ইত্যাদি থাকলেও, তাঁরা প্রধানত রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবত ইত্যাদি গ্রন্থগুলির অনুবাদই বেশি করেছেন। কারণ কাব্যসৌন্দর্য অপেক্ষা ধর্মীয় মাহাত্মের দিকেই তাঁরা বেশি আগ্রহী ছিলেন। পরবর্তীকালেও অনুবাদের ক্ষেত্রে এটা লক্ষ করা যায়।

     প্রথম যুগের অনুবাদকরা অনুবাদ করার সময় মৌলিক চিন্তা অপেক্ষা, মূল গ্রন্থের যে অনুসরণ করতে চাইবেন, তা ছিল স্বাভাবিক এবং হয়েছেও তাই। কৃত্তিবাস ছাড়া অন্য কবিরা, যেমন- মালাধর বসু, শ্রীকর নন্দী, কবীন্দ্র পরমেশ্বর প্রমুখ মোটামুটি ভাবে মূল গ্রন্থকেই অনুসরণ করেছেন। তবে মালাধর বসু মূল ভাগবতের অংশবিশেষ অনুবাদ করেছিলেন। শ্রীকর নন্দী জৈমিনি মহাভারতের অশ্বমেধ পর্ব অনুবাদ করেছিলেন।

    তবে বাংলাভাষায় সংস্কৃত বহু গ্রন্থের অনুবাদ হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এর ফলে বাংলা ভাষা সমৃদ্ধিশালিনীও হয়েছে এবং বাংলা ভাষার সম্পদও বৃদ্ধি পেয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে রাজা রামমোহন রায় কয়েকটি উপনিষদ্‌ ও বেদান্তের অনুবাদ করেছিলেন। রমেশচন্দ্র দত্ত গ্বেদের অনুবাদ করেছিলেন। রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী করেছিলেন তরেয় ব্রাহ্মণের অনুবাদ। নবীনচন্দ্র দাস রঘুবংশের পদ্যানুবাদ করেছিলেন। এর পাশাপাশি কালিদাসের প্রতিটি কাব্যের অনুবাদ হয়েছে। এছাড়া পাণিনির ব্যাকরণ, সিদ্ধান্ত কৌমুদী, পতঞ্জলির মহাভাষ্য, অমরকোষ, সাহিত্যদর্পণ, মনুসংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা ইত্যাদি গ্রন্থও অনুবাদ হয়েছে।

    ইংরেজি এবং সংস্কৃত সাহিত্যের পাশাপাশি পালি ও প্রাকৃত বহু গ্রন্থের অনুবাদ বাংলা ভাষায় হয়েছে। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কল্পসূত্র, জগরাম ভট্টাচার্যের দশবৈকালিক সূত্র, রাধাগোবিন্দ বসাকের গাথাসপ্তশতীর অনুবাদ সর্বজনবিদিত। ঈশানচন্দ্র ঘোষের জাতকের অনুবাদ তো বিশেষভাবেই উল্লেখযোগ্য ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ