চরিতকথা - রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী রচিত প্রবন্ধ 'বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়' (শেষ পর্ব)
বঙ্কিমচন্দ্র যাহার মূলে নাই, সেই জিনিস বাঙ্গলা
দেশে চলে না। রামমোহন রায় বাঙ্গলা ভাষার সাহায্যে বাঙ্গলা-সাহিতের সৃষ্টির প্রয়াস
পাইয়াছিলেন, কিন্তু তাহার চেষ্টা চলে নাই; তাঁহার পরর্তী শিক্ষিত বাঙ্গালী সেই গতির রোধ করিয়াছিলেন । ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর সংস্কৃত ভাষার ও সংস্কৃত সাহিত্যের পুণ্যতোয়ে বাঙ্গলা ভাষাকে স্নান
করাইয়া তাহার দীপ্ত কলেবর শিক্ষিত-সমাজের সম্মুখে উপস্থিত করিয়াছিলেন; কিন্তু শিক্ষিত সমাজ তাহার প্রতি শ্রদ্ধাপ্রকাশ কর্তব্য বোধ করে নাই ।
রামমোহন রায়ের ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দেব-দেহের জ্যোতির্মণ্ডিত শিরোভূষণ
হইতে একখানি মাণিক্য অপসারণ না করিয়াও আমরা স্বীকার করিতে পারি যে, তাঁহারা যে কার্যে অসমর্থ হইয়াছিলেন, বঙ্কিমচন্দ্রের
প্রতিভা অবলীলাক্রমে সেই কার্য সম্পাদনে সমর্থ হইয়াছিল।
আমার প্রিয়সুহৃৎ শ্রীযুক্ত হীরেন্দ্রনাথ দত্ত মহোদয় সে দিন রাগের
মাথায় তাহার বহু পরিশ্রমে উপার্জিত ইংরেজী বিশ্ববিদ্যালয়-দত্ত ডিপ্লোমাখানিকে ‘চোত৷ কাগজ’ বলিয়৷ ফেলিয়াছেন। উপস্থিত
প্রবন্ধলেখকেরও ঐরূপ একখানি কাগজ আছে ; কিন্তু যখন উহার উপর
নির্ভর করিয়াই জীবিকা অর্জন করিতেছি এবং উহার বলেই আজি আপনাদের সম্মুখে দাঁড়াইতে
সাহস করিতেছি, তখন ঐ কাগজখানির প্রতি ওরূপ অপভাষা প্রয়োগ করিতে
চাহি না। এ বৎসর অনেকে বিলাতী লবণ খাইব না, এই জেদ করিয়াছেন,
কিন্তু আমাদের রক্তবিন্দুর রাসায়নিক বিশ্লেষণে এখনও ঐ দ্রব্যের অস্তিত্ব
ধরা পড়িবে। এত দিন ধরিয়া বিলাতী লবণ হজম করিয়৷ তাহার গুণ গাইব না. পণ ধরিয়া বসিলে
নিমকহারামি হইবে । পাশ্চাত্য শিক্ষা হইতে আমরা কোন উপকারই পাই নাই, এ কথা পুরা দমে বলিতে পারিব না। পাশ্চাত্য শিক্ষা হইতে কিছু লাভ করিয়াছি
সত্য, কিন্তু পাশ্চাত্য শিক্ষা আমাদের সকলকেই অল্পবিস্তর মুগ্ধ
ও অভিভূত করিয়াছিল, ইহাও ততোধিক সত্য । বঙ্কিমচন্দ্রের
জীবনোতিহাস যাহারা অবগত আছেন, তাঁহারা জানেন, বঙ্কিমচন্দ্রও এই আক্রমণ হইতে নিস্তার পান নাই।
তবে বঙ্কিমের সহিত অন্যের এ বিষয়ে প্রভেদ আছে। নীর বর্জন করিয়া ক্ষীর
গ্রহণের ক্ষমতা একা রাজহাসেরই আছে। বঙ্কিমচন্দ্ররূপী রাজহংস পাশ্চাত্য নীর হইতে যে
পরিমাণ ক্ষীর সংগ্রহ করিয়া স্বজাতিকে উপহার দিয়াছেন, আমাদের মত দাঁড়কাকের দ্বারা ততটার সম্ভাবনা নাই। বঙ্কিমচন্দ্রের মাহাত্ম্য
এই যে, তিনি কেবল ক্ষীর সংগ্রহ করিয়৷ নিরস্ত হন নাই,
তিনি পাশ্চাত্য শিক্ষার আকর্ষণ ও মোহপাশ সবলে ছিন্ন করিয়া ডঙ্কা
বাজাইয়৷ আপন ঘরে ফিরিয়াছিলেন ও মাতৃমন্দিরে আনন্দমঠের প্রতিষ্ঠা করিয়া আমাদিগকে
তাহার ভিতরে আহ্বান করিয়াছিলেন।
‘বঙ্গদর্শনে’র বঙ্কিমচন্দ্র পাশ্চাত্য শিক্ষার
মোহবদ্ধন সম্পূর্ণ কাটাইয়াছিলেন কি না, বলিতে পারি না,
কিন্তু ‘প্রচারে’র পশ্চাতে
যে বঙ্কিমচন্দ্র দাঁড়াইয়াছিলেন, তাহাকে রাহুগ্রাসমুক্ত পূর্ণচন্দ্রের
মত দীপ্তিমান্ দেখি। তিনি
তখন গীতার উক্তির আশ্রয় লইয়৷ স্বদেশবাসীকে ভয়াবহ পরধর্ম হইতে স্বধর্মে প্রত্যাবৃত্ত
হইতে আহ্বান করিতেছিলেন। ভয়াবহ অভিধান
দিয়া পরধর্মকে নিন্দা করা আমার অভিপ্রেত নহে; ধর্মের একটা
সার্বভৌমিক এবং সনাতন অংশ আছে, তাহা সকল ধমেই সমান; সে অংশটুকুতে কাহারও ভীত হইবার কোন কারণ নাই, কিন্তু
ধর্মের আর একটা অংশ আছে, তাহা দেশভেদে মূর্ত্যন্তর গ্রহণ
করে। ধর্ম যখন লোকস্থিতির সহায়, এবং লোকস্থিতির নিয়ম যখন
বিভিন্ন দেশে ও বিভিন্ন কালে বিভিন্ন, তখন ধর্মের এই অংশ দেশ-কালের
অপেক্ষা না করিয়া থাকিতে পারে না।
কোন দেশেই মানব-সমাজের অবস্থা চিরদিন সমান থাকে না। একটা মানব সমাজ পার্শ্ববর্তী
মানব-সমাজের সংস্পর্শে বা সংঘর্ষে আসিয়া তাহার সমাজব্যবস্থা পরিবর্তিত করিতে বাধ্য
হয়। কাজেই ধর্মের এই অংশ দেশকালানুরূপ না হইলে উহা তদ্দেশে ও তৎকালে লোকস্থিতির
অনুকূল হয় না। তত্তৎদেশে ধর্মের এই অংশের সহিত তত্তৎদেশের প্রাচীন ইতিহাসের ঘনিষ্ঠ
সন্বন্ধ। প্রাচীনের সহিত সম্পর্ক একেবারে বিচ্ছিন্ন করিলে কোন সামাজিক ব্যবস্থাই
কোন দেশে লোকস্থিতির অনুকূল হয় না। যখন বিভিন্ন সমাজের ইতিহাস বিভিন্ন পথে
চলিয়াছে,
তখন লোকস্থিতির অনুরোধে ধর্মকেও আত্মসমাজের অনুকূল মূর্তি গ্রহণ করিতে
হয়। এইখানেই আত্মধর্ম ও পরধর্মে ভেদ আসিয়া পড়ে। যে ধর্ম এক সমাজে লোকস্থিতির
অনুকূল, সে ধর্ম অন্য সমাজে অনুকূল না হইতে পারে ।
এইখানে এ কথাট৷ মনে রাখিতে হইবে যে, ধর্ম শব্দের
লক্ষ্য কেবল রিলিজন নহে । আমাদের শাস্ত্রে ধর্ম শব্দের সংজ্ঞা আরও ব্যাপক; মানুষের অনুষ্ঠেয় প্রত্যেক কর্ম, দাঁতন-কাঠির
ব্যবহার হইতে ঈশ্বরোপাসনা পর্যন্ত সমস্তই ধর্মের অন্তভূক্ত। এই হিসাবে যাহা
বিদেশীয় ধর্ম, তাহা ভারতবাসীর ধর্ম হইতেই পারে না। ইয়রোপের
প্রাচীন ইতিহাস ও ইয়ুরোপের আধুনিক সমাজতন্ত্র যখন ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস ও ভারতবর্ষের আধুনিক সমাজতন্ত্রের
সহিত এক নহে, তখন ইয়ুরোপীয়দের ধর্ম আমাদের পক্ষে পরধর্ম।
উহাদের খ্রিষ্টানীর কথা বলিতেছি না, উহাদের আইন কানুন,
আহার-বিহার, চাল-চলন, আদব-কায়দা,
সমস্তই আমাদের নিকট পরধর্ম; আমাদের ধর্মও তেমনি
উহাদের নিকট পরধর্ম; এবং বিনা বিচারে ও বিনা কারণে একের পক্ষে
অন্য ধর্ম গ্রহণ প্রকৃতপক্ষেই ভয়াবহ। সৌভাগ্যক্রমে এই পরধর্মবাৎসল্যের মোহ শীঘ্রই কাটিয়া গিয়াছিল, এবং বঙ্কিমচন্দ্র যখন তাহার স্বজাতিকে আপন ঘরে ফিরিবার জন্য ডাক দিলেন,
তখন আমরা আগ্রহের সহিত সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলাম। আজ আমরা যে আপন ঘরে প্রত্যাবর্তনের জন্য ব্যাকুল
হইয়াছি,
বিশ বৎসর পূর্বেই সেই প্রত্যাবর্তনের ডাক পাড়য়াছিল; এবং বঙ্কিমচন্দ্রের পথভ্রষ্ট স্বদেশবাসী সেই ডাকে সাড়া দিতে ঔদাসীন্য
দেখায় নাই। আজ
সেই ডাক আরও উচ্চৈঃস্বরে পড়িয়াছে, এবং তপস্বী
বঙ্কিমচন্দ্র মর্ত্যলোকের তপস্যার সমাধান করিয়া অদৃশ্য তপোলোক হইতে আমাদিগকে সেই
পারচিত স্বরে আবার ডাকিতেছেন।
বঙ্কিমচন্দ্রকে কেহ কেহ Apostle of culture
বলিয়া থাকেন। ধর্মের সার্বভৌমিক অংশের আলোচনায় প্রবৃত্ত হইয়া বঙ্কিমচন্দ্র
সমুদয় বৃত্তির সর্বাঙ্গীণ সামঞ্জস্য বিধানকে ধর্ম বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিলেন। আমরা
ধর্মের এই সংজ্ঞা স্বচ্ছন্দে গ্রহণ করিতে পারি। পূর্বেই বলিয়াছি, বহিঃপ্রকৃতির সহিত অন্তঃপ্রকৃতির অবিরত সামঞ্জস্য-সাধন-চেষ্টার নাম জীবন,
এবং যখন সমুদয় বৃত্তির সর্বাঙ্গীণ সামঞ্জস্য-বিধান না ঘটিলে
বহিঃপ্রকৃতির সহিত অন্তঃপ্রকৃতির পূর্ণ সামঞ্জস্য ঘটিবার সন্তাবনা নাই, তখন ধর্মই জীবনরক্ষার এক মাত্র উপায় - “ধর্মোঃ রক্ষতি
রক্ষিতঃ”। ধর্মই
মানব-জীবনকে রক্ষা করে, কেবল ব্যক্তির জীবন বা বংশের জীবন কেন,
সমাজের জীবনও ধমই রক্ষা করে; এবং যদি কেহ ঐহিক
জীবনের উপর পারত্রিক জীবনের রক্ষাকেও ধর্মের উদ্দেশ্য বালিতে
চাহেন, তাহারও সহিত আমি আজ বিবাদ করিতে
প্রস্তুত নহি। বঙ্কিমচন্দ্র-প্রযুক্ত ধর্মের এই বৈজ্ঞানিক সংজ্ঞা গ্রহণ করিলে, উহা culture অপেক্ষা ব্যাপক হইয়া উঠে। এই ধর্মের অন্বেষণের
জন্য বঙ্কিমচন্দ্র আপন ঘরে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া গীতাশাস্ত্রের
আশ্রয় লইয়াছিলেন। এই ব্যাপক অর্থে ধর্ম শব্দ প্রয়োগ করিলে সার্বভৌমিক ও
প্রাদেশিক, উভয় ধর্ম উহার অন্তর্নিবিষ্ট
হইয়া পড়ে; এবং বঙ্কিমচন্দ্র দেখাইতে
চাহিয়াছিলেন, সেই সার্বভৌমিক ধর্মের বা প্রাদেশিক যুগধর্মের
অন্বেষণের জন্যও আমাদিগকে পরের দ্বারে ভিক্ষার্থী হইয়৷
দাড়াইতে হইবে না। আজ গীতার সুলভ সংস্করণ লোকের পকেটে-পকেটে
বিরাজ করিতেছে, কিস্তু বঙ্কিমচন্দ্র যে সময়ে গীতার ব্যাখ্যা
করিতে প্রবৃত্ত হন, তখন ইংরেজী শিক্ষিত লোকের মধ্যে উহা
বিরলপ্রচার ছিল । কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্র যাহার মূলে, বাঙ্গল৷
দেশে সে জিনিস অচল থাকে না, তাহা প্রচলিত হয়; তাই বঙ্কিমচন্দ্র যে
দিন ‘নবজীবন’ ও ‘প্রচার’
আশ্রয় করিয়া বঙ্গবাসীকে তাহার আপন শাস্ত্রের সাহত পরিচিত করিলেন, সেই দিন হইতে সেই শাস্ত্রকথা বাঙ্গলা দেশের শিক্ষিত সমাজে চলিতে লাগিল । তদবধি উহা আর থামে নাই ।
বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথমে শাক্ষিত বাঙ্গালীর
সম্মুখে স্বদেশের শাস্ত্র স্থাপন
করিয়াছিলেন, এ কথা বললে ভুল হইবে । তাহার অনেক পূর্বে
বঙ্গজননীর আর এক সন্তান বিশ্বজগতে পুরাণকবির চতুর্মুখনিঃসৃত
এবং ভারতের প্রাচীন ঋষিগণের শ্রুতিপ্রবিষ্ট
বাণীর মধ্যে সার্বভৌমিক ধর্মের সন্ধান পাইয়া পুলকিত হইয়াছিলেন; এবং তাঁহার পরে
বঙ্গজননীর আর এক জন সম্তান ঈশোপনিষদ গ্রন্থের পরিত্যক্ত
পাতার মধ্যে সেই ধর্মের সন্ধান পাইয়া আপনাকে ধন্য মানিয়াছিলেন।
মাহাত্মা রামমোহন রায় ও মহষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর শ্রুতিবাক্যের
যে অর্থ গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহা আমি গ্রহণ করিতে পারি নাই।
কিন্তু তাঁহারা ভারতবর্ষকে স্বকীয় সামর্থ্যের
উপর আত্মপ্রতিষ্ঠা করিতে আহ্বান করিয়া ভারতবাসীর যে জ্ঞানান্ধতা
অপনোদন করিয়৷ গিয়াছেন, তজ্জন্য আমি তাঁদের স্বদেশে জন্মিয়া ধন্য হইয়াছি। এ কথা গোপন করিবার
প্রয়োজন নাই যে, এ দুই মহাপুরুষের অনুবর্তীরা ধর্মতত্ত্বের অনুসন্ধানের জন্য বিদেশে যাত্রা আবশ্যক বোধ করিয়াছিলেন এবং অন্য দেশের
অন্য জাতির শাস্ত্র হইতে সার্বভৌমক ধর্মের সার সঙ্কলনে
প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। ধর্মপিপাসুর পিপাসা
যদি তাঁহাদিগকে পানীয় অন্বেষণে পৃথিবী
ভ্রমণে বাধ্য করে, তাহাতে দুঃখিত হইবার কোন কারণ নাই। এই
বিদেশ-যাত্রীদিগের পরিশ্রমের জন্য আমরা তত দুঃখিত নহি, কিন্তু বিদেশের আকর্ষণে তাঁহারা স্বদেশী
সামগ্রীর প্রতি যদি উপেক্ষা বা অবজ্ঞা
প্রদর্শন করিয়া থাকেন, তাহার জন্য ক্ষোভ কারবার হেতু আছে।
যাহাই হউক, ধর্মতত্বের অনুসন্ধানে বিদেশ পর্যটন অনাবশ্যক
হইলেও আমরা ঐ অনাবশ্যক পরিশ্রমে
প্রবৃত্ত হইয়াছলাম; এমন সময় বঙ্কিমচন্দ্র আমাদিগকে আপন ঘরে প্রত্যাবর্তনের জন্য ডাক দিলেন। শিক্ষিত বাঙ্গালী সেই আহ্বান শুনিল ও মাতৃমন্দিরে- আনন্দমঠে
ফিরিয়া আসিতে সঙ্কোচ বোধ করিল না।
গীতাশাস্ত্র ধর্মের কেবল সার্বভৌমিক সনাতন অংশের উপদেশ দিয়া নিরস্ত হয় নাই, প্রাদেশিক ধর্ম ও যুগধর্মের তত্বও এ শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য।
কয়েক সহস্র বংসর ধরিয়া ভারতবাসী গীতাশাস্ত্রে যে সহস্রশীর্ষ পুরুষের মুখনিঃসৃত অভয়বাণী শুনিয়া আসিতেছে,
তাহার সহস্র অক্ষি সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ও ব্রহ্মাণ্ডের ক্ষুদ্রতম অংশে নিবন্ধ আছে। অতএব ঐ শাস্ত্রের উক্তির মধ্যে
প্রাদেশিক ধর্মের ও যুগধর্মের মাহাত্ম্য-কীর্তন দেখিয়া বিস্মিত হইতে হইবে ।
যুগধর্ম
সংস্থাপনের জন্য যিনি যুগে যুগে সম্ভূত হন,
তিনি ধর্মক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রের মহাহবের যুগে কোন মুর্তিতে সম্ভূত হইয়াছিলেন, মহাভারতের মহাসাগর মন্থন করিয়া ভারতবাসীর নিকট লপ্তপ্রায় সেই মূর্তি
উদ্ধারের জন্য বঙ্কিমচন্দ্র যত্নপর হইয়াছিলেন। লুপ্তপ্রায় বলিলাম, তাহার একটু তাৎপর্য আছে। ভারতবর্ষের
বৈষ্ণব-সম্প্রদায় ভগবানের যে মূর্তিকে
পূজার জন্য আগ্রহের সহিত গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহা কুরুক্ষেত্র সংশপ্তক সেনার সম্মুখীন পার্থসারথির মূর্তি নহে, তাহা বৃন্দাবনবিহারী গোপীজনবল্লভ বংশীবদনের মার্তি; তাহা নবনীতচৌর উদুখলবদ্ধ বালগোপালের মূর্তি; তাহা
বৎসকুলের সহিত কেলিপর যমুনাপুলিনবিহারী গোপসখার মূর্তি
– যে মূর্তিতে ভগবান শ্রীকরধৃত মোহন মুরলীর প্রত্যেক
রন্ধ্র শ্রীমুখমারুতে পূর্ণ কারিয়া
তদুদ্গত স্বরস্রোতে বিশ্বপ্রকৃতির মর্মস্থলে আনন্দের ধারা সঞ্চার করেন, উহা সেই মূর্তি। ঈশ্বরের ঐশ্বর্যমণ্ডিত মূর্তি ভারতবর্ষের উপাসক-সম্প্রদায়ের
সম্পূর্ণ তৃপ্তি জন্মাইতে পারে নাই;
ভারতবাসী ঐশ্বর্যের অপেক্ষা মাধুর্যের উপাসনায় পক্ষপাতিতা দেখাইবে, ইহাতেও বিস্মিত হইব
না।
বঙ্কিমচন্দ্র মহাভারতসাগর মন্থন করিয়া যে মূর্তিকে স্বদেশবাসীর
সম্মুখে স্থাপন করিয়াছিলেন, তাহা যুগধর্মপ্রবর্তকের মূর্তি; তাহা ধর্ম রাজ্যসংস্থাপকের মূর্তি – ধর্মের সহিত অধর্মের সংঘর্ষ উপস্থিত হইলে যে মূর্তি গ্রহণ করিয়া তিনি সম্ভূত হন, উহা সেই মূর্তি; রাষ্ট্র বিপ্লব
উপস্থিত করিয়া যান রাষ্ট্র রক্ষা করেন, উহা তাঁহার মূর্তি; জীবন-সংগ্রামে জীবন ধ্বংস করিয়া যিনি জীবন রক্ষা করেন,
উহা তাহার মুর্তি; লোকস্থিতির অনুরোধে যান নির্বিকার ও নিষ্করুণ হইয়া বসুন্ধরাকে শোণিতক্লিন্ন দেখিয়া
থাকেন, উহা তাঁহারই মূর্তি। যিনি বিশ্বজগতের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সঞ্চারিত করুণাপ্রবাহের এক মাত্র উৎস, তিনি যে কি কারণে ও কি উদ্দেশ্যে
এই নিষ্করুণ মূর্তি পরিগ্রহ করিয়া
জীবরক্তে বসুধা সিক্ত দেখিতে বাধ্য হন, তাহা তিনিই জানেন;
মনুষ্যের শাস্ত্র এখানে মূক; অথবা এই মূর্তিগ্রহণ সেই সনাতন মায়ার সহিত অভিন্ন, - যাহা হইতে এই বিশ্বজগতের জন্মাদি, যাহা হইতে জীবের জীবন, যাহা হইতে জীবনে বহিঃপ্রকৃতির সহিত অন্তঃপ্রকৃতির নিরন্তর সামঞ্জস্য
স্থাপনের চেষ্টা ঘটিতেছে, যাহা হইতে
মানবের সকল দুঃখের নিদান সেই খ্রীষ্টান-কথিত পাপপ্রবণতার উৎপত্তি হইয়াছে; অথবা কবির ভাষায় বলিতে পারি,
- ইহা সেই আধ-সত্য, জ্ঞানী যখন তাঁহার আত্মার মধ্যে জগৎ কারণের সন্ধান পাইবেন,
যখন তিনি আপনাকেই এই জগদভ্রান্তির কারণ বলিয়া জানিতে পারিবেন, যখন তাঁহার অপূর্ণ জগৎস্বপ্ন উদ্বোধন বিলীন হইবে, তখন সেই মহাস্বপ্নভাঙ্গা
দিনে যে আধ-সত্য-
সত্যের সমুদ্রমাঝে হ’য়ে যাবে
লীন ।
বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’ আর বঙ্কিমচন্দ্রের ‘কৃষ্ণচরিত্রে’ও আমরা এই যুগধর্ম
প্রতিষ্ঠার বিশিষ্ট চেষ্টা দেখিতে পাই।
তাঁহার জীবনের শেষ ভাগের প্রত্যেক কার্যই বোধ করি এই উদ্দেশ্যের অভিমুখ । বঙ্কিমচন্দ্রই প্রথমে আমাদিগের নিকট যুগধর্মের আবশ্যকতা নির্দেশ করিয়াছিলেন এবং যুগধর্মের
সংস্থাপনের জন্য যিনি যুগে যুগে সম্ভূত হন, তাহার মহৈশ্বর্যমণ্ডিত মূর্তি
আমাদের হৃদয়-মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। বঙ্গজননীর প্রত্যেক সন্তানের হৃদয়ভূমি মাতৃভক্তির জাহ্নবী-জলে মার্জিত করিয়া তাহাকে তাঁহার সিংহাসন স্থাপনের উপযোগী
করিতে হইবে। তিনি যে পবিত্র আসনে উপবিষ্ট হইবেন, তাহা পূণ্য তোয়ে অভিষিক্ত করা আবশ্যক ।
0 মন্তব্যসমূহ