জেনেরিক বাংলা (GE-1) নোটস্
প্রশ্ন: প্রাচীন বাংলার নদ - নদীর পরিচয় দাও।
উত্তর: বাংলাদেশ নদীপ্রধান দেশ। এখানকার নদ-নদীর বাহুল্য
যেমন এদেশের ভূমিকে উর্বর ও শস্যশালিনী করেছে, তেমনি নদ-নদীর
গতিপরিবর্তন এখানকার নগরীর অবক্ষয় ও বিলুপ্তিরও কারণ হয়ে উঠেছে।
বাংলাদেশের প্রধান নদী গঙ্গা। রাজমহল পাহাড়ের উত্তর-পশ্চিম অংশের তেলিয়াগড় ও সকরিগলির খাত অতিক্রম করে গঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এখান থেকে গঙ্গার একটি ধারা দক্ষিণদিকে ও অপরধারা দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়েছে। দক্ষিণ ধারাটা একসময় গৌড় নগরের উত্তর-পূর্বদিকে প্রবাহিত হত। গৌড় তখন গঙ্গার দক্ষিণতীরে অবস্থিত ছিল। পরবর্তীকালে নদীর গতি ক্রমশ দক্ষিণ ও পশ্চিমদিকে সরে যেতে থাকে । পরবর্তীকালে, প্রাচীন গৌড়ের পঁচিশ মাইল দক্ষিণে গঙ্গা দুটি শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। দক্ষিণ দিকের শাখাটির নাম হয় ভাগীরথী আর দক্ষিণ-পূর্বের শাখাটির নাম হয় পদ্মা। ভাগীরথীর প্রবাহ আরও দক্ষিণে এসে হুগলী নামে পরিচিত হয়েছে। পশ্চিমদিক থেকে বাঁশলোই, মোর, অজয় নদের স্রোত এসে ভাগীরথীর সঙ্গে মিশেছে। হুগলীর কাছে ত্রিবেণীতে ভাগীরথীর সঙ্গে তার দুটি শাখানদী সরস্বতী ও যমুনা এসে মিশেছে। সরস্বতী প্রবাহিত হয়েছে দক্ষিণ-পশ্চিমে, যমুনা দক্ষিণ-পূর্বে, মূল ভাগীরথীর স্রোতটি দক্ষিণদিক বরাবর প্রবাহিত হয়েছে। হুগলী নামে পরিচিত এই প্রবাহটি কলকাতা পর্যন্ত এসে তারপর আদিগঙ্গা নামে সমুদ্রে মিশেছে।
পদ্মা নামে গঙ্গার যে দক্ষিণ-পূর্বমুখী প্রবাহটি তার গতিপথ বারেবারেই পরিবর্তিত হয়েছে। অনুমিত হয়, প্রথমদিকে এই নদীস্রোত রামপুর বোয়ালিয়া হয়ে চলনবিলের মধ্য দিয়ে এবং ঢাকার পাশ দিয়ে প্রবাহিত ধলেশ্বরী ও বুড়ীগঙ্গা হয়ে মেঘনা নদীর মোহনায় পড়ত। আঠারো শতকে পদ্মার নিম্নাংশ আরও দক্ষিণে ছিল। পদ্মা ফরিদপুর ও বাখরগঞ্জের মধ্যে দিয়ে দক্ষিণে মেঘনার মোহনায় পড়েছে। কালিগঙ্গা নামে একটি নদীর মাধ্যমে পদ্মা মেঘনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে। উনিশ শতকের মধ্যভাগে এ স্রোতেই পদ্মা প্রবাহিত হত। তার নাম ছিল কীর্তিনাশা। গোয়ালন্দের কাছে পদ্ৰা ব্রন্মপুত্রের প্রধান শাখা যমুনার সঙ্গে মিলিত হয়ে বরিশাল ও নোয়াখালি জেলার ভিতর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের অন্যান্য নদীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য মযুরাক্ষী, অজয়, দামোদর, দ্বারকেশ্বর, রূপনারায়ণ ও কাঁসাই। এই নদীগুলি ছোটনাগপুরের মালভূমি থেকে নির্গত হয়ে ভাগীরথীর সঙ্গে মিশেছে। নদীটির মূল নাম ছিল ত্রিস্রোতা। করতোয়া, পুনর্ভবা ও আত্রাই এই তিনটি স্রোতের সমাহার ছিল। করতোয়া নদীর তীরে গড়ে উঠেছিল প্রাচীন পুণ্ড্রবর্ধন নগরী। ১৭৮৭ সালের দিকে তিস্তা তার পুরোনো গতি পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পূর্বদিকে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হয়। উত্তরবঙ্গের কোশী নদীরও গতি পরিবর্তিত হয়েছে। একসময় কোশী ও মহানন্দা করতোয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে উত্তরের কোচ, কিরাত প্রভৃতি আদিবাসীদের থেকে দক্ষিণের জাতিগুলিকে স্বতন্ত্র করেছে।
বাংলাদেশের নদ-নদীর গতিপরিবর্তন বাংলাদেশের
ভাগ্যবিড়ম্বনার কারণ হয়েছে। তাম্রলিপ্তির ও সপ্তগ্রামের মতো বন্দর নগরীগুলির
উত্থানপতন নদীর গতিপথের উপর নির্ভর করেছে। গৌড় নগরীর পতন, কোটালিপাড়ার অবক্ষয়, যশোহর-খুলনার আভ্যন্তরীণ
পরিবর্তন এই নদ-নদীর গতিপরিবর্তনের অনিবার্য পরিণাম ।
0 মন্তব্যসমূহ