ছিন্নপত্র - ১০৩রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পতিসর
৩০ মার্চ্চ, ১৮৯৪।
এত অকারণ আশঙ্কা এবং কষ্ট মানুষের অদৃষ্টে থাকে!
ছোট বড় এত সহস্র বিষয়ের উপর আমাদের মনের সুখ শান্তি নির্ভর করে। অনেক দুঃখ আছে যা
আমার নিজকৃত এবং যা সবিনয়ে সহিষ্ণুভাবে বহন করা কর্তব্য মনে হয় - কিন্তু চিঠি না
পেয়ে যখন আশংকা হয় যে বুঝি একটা কিছু বিপদ কম্বা ব্যামো হয়েছে তখন কষ্টটাকে শান্ত
করবার জন্যে হাতের কাছে কোন ফিলজফিই পাওয়া যায় না। তখন বুদ্ধি একেবারে কাজের বার
হয়ে যায়। কাল সমস্তক্ষণ বেড়াতে বেড়াতে এমন সকল অসম্ভব এবং অসঙ্গত কল্পনা মনে উদয়
হচ্ছিল এবং বুদ্ধি তার কোন প্রতিবাদ করছিল না যে আজ তা স্মরণ করে হাসি পাচ্চে লজ্জাও
বোধ হচ্চে - অথচ স্থির নিশ্চয় জানি যে, আসচে বারে, যেদিন এইরকম ঘটনা হবে ঠিক আবার
এরই পুনরাবৃত্তি হবে। আমি অনেকবার বলেছি বুদ্ধিটা মানুষের নিজস্ব জিনিস নয়, ওটা এখনো
আমাদের মনের মধ্যে ন্যাচারালাইজড্ হয়ে যায়
নি।
যখন মনে করি জীবনের পথ সুদীর্ঘ, দুঃখ দুঃখ-কষ্টের কারণ অসংখ্য এবং অবশ্যম্ভাবী
তখন এক এক সময় মনের বল রক্ষা করা প্রাণপণ কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় সন্ধ্যের সময়
একলা বসে বসে টেবিলের বাতির আলোর দিকে দৃষ্টি নিবিষ্ট মনে করি জীবনটাকে বীরের মত অবিচলিত
ভাবে নীরবে বিনা অভিযোগে বহন করব- সেই
কল্পনায় মনটা উপস্থিতমত অনেকখানি স্ফীত হয়ে ওঠে এবং আপনাকে হাতে হাতে একজন মস্ত বীরপুরুষ
বলে ভ্রম হয়- তার পরে পথ চলতে পায়ে যেই কুশের কাঁটাটি ফোটে অমনি যখন লাফিয়ে উঠি তখন
ভবিষ্যতের পক্ষে ভারি সন্দেহ উপস্থিত হয়, তখন আবার জীবনটাকে সুদীর্ঘ এবং আপনাকে সম্পূর্ণ
অযোগ্য মনে হয়। কিন্তু সে যুক্তিটা বোধ হয় ঠিক নয়- বাস্তবিক, বোধ হয় কুশের কাঁটায়
বেশি অস্থির করে। মনের ভিতরে একটি গোছালো গিন্নীপনা দেখা যায় - সে দরকার বুঝে ব্যয়
করে, সামান্য কারণে বলের অপব্যয় করতে চায়না। সে যেন বড় বড় সংকট এবং আত্মত্যাগের
জন্য আপনার সমস্ত বল কৃপণের মত সযত্নে সঞ্চয় করে রাখে। ছোট ছোট বেদনায় হাজার কান্নাকাটি
করলেও তার রীতিমত সাহায্য পাওয়া যায় না। কিন্তু যেখানে দুঃখ গভীরতম সেখানে তার আলস্য
নেই। এই জন্যে জীবনে একটা প্যারাডক্স দেখা যায় যে, বড় দুঃখের চেয়ে ছোট দুঃখ যেন
বেশি দুঃখকর। তার কারণ, বড় দুঃখে হৃদয়ের যেখানটা বিদীর্ণ হয়ে যায় সেইখান থেকেই একটা
সান্ত্বনার উৎস উঠতে থাকে, মনের সমস্ত দলবল সমস্ত ধৈর্য্যবীর্য্য এক হয়ে আপনার কাজ
করতে থাকে, তখন দুঃখের মাহাত্ম্যের দ্বারাই তার সহ্য করবার শক্তি বেড়ে যায়। মানুষের
হৃদয়ে একদিকে যেমন সুখ লাভের ইচ্ছা তেমনি আর একদিকে আত্মত্যাগের ইচ্ছাও আছে; সুখের ইচ্ছা যখন নিষ্ফল হয় তখন আত্মত্যাগের
ইচ্ছা বলিষ্ঠ হয়ে ওঠে এবং সেই ইচ্ছার চরিতার্থতা সাধন করবার অবসর পেয়ে মনের ভিতরে
একটা উদার উৎসাহসঞ্চার হয়। ছোট দুঃখের কাছে আমরা কাপুরুষ কিন্তু বড় দুঃখ আমাদের বীর
করে তোলে, আমাদের যথার্থ মনুষ্যত্বকে জাগ্রত করে দেয়। তার ভিতরে একটা সুখ আছে। দুঃখের
সুখ বলে একটা কথা অনেকদিন থেকে প্রচলিত আছে সেটা নিতান্ত বাকচাতুরী নয় এবং সুখের অসন্তোষ
একটা আছে সেও সত্য। তার মানে বেশি শক্ত নয়। যখন আমরা নিছক সুখ ভোগ করতে থাকি তখন আমাদের
মনের একার্দ্ধ অকৃতার্থ থাকে, তখন একটা কিছুর জন্যে দুঃখ ভোগ এবং ত্যাগ স্বীকার করতে
ইচ্ছে করে, নইলে আপনাকে অযোগ্য বলে মনে হয়- এই কারণেই যে সুখের সঙ্গে দুঃখ মিশ্রিত
সেই সুখই স্থায়ী এবং সুগভীর, তাতেই যথার্থ আমাদের সমস্ত প্রকৃতির চরিতার্থতা হয়।
কিন্তু সুখ দুঃখের ফিলজফি ক্রমেই বেড়ে চলতে লাগলো।
0 মন্তব্যসমূহ