Header Ads Widget

WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা ** WELCOME! ** 100% MOBILE FRIENDLY ONLINE EDUCATIONAL BLOG ** বাংলা সাহিত্য চর্চা **

ticker

6/recent/ticker-posts

ছিন্নপত্র – ১০৬ - রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 ছিন্নপত্র – ১০৬
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর


শিলাইদা,

২৭শে জুন, ১৮৯৪।

কাল থেকে হঠাৎ আমার মাথায় একটা হ্যাপি থট এসেছে. আমি চিন্তা করে দেখলুম পৃথিবীর উপকার করব ইচ্ছা থাকলেও কৃতকার্য্য হওয়া যায় না; কিন্তু তার বদলে যেটা করতে পারি সেইটে করে ফেললে অনেক সময় আপনিই পৃথিবীর উপকার হয়, নিদেন যাহোক একটা কাজ সম্পন্ন হয়ে যায়। আজকাল মনে হচ্চে, যদি আমি আর কিছুই না করে ছোট ছোট গল্প লিখতে বসি তাহলে কতকটা মনের সুখে থাকি এবং কৃতকার্য্য হতে পারলে হয়তো পাঁচজন পাঠকেরও মনে সুখের কারণ হওয়া যায়। গল্প লেখবার একটা সুখ এই, যাদের কথা লিখব তারা আমার দিনরাত্রির  সমস্ত অবসর একেবারে ভরে রেখে দেবে, আমার একলা মনের সঙ্গী হবে, বর্ষার সময় আমার বদ্ধ ঘরের সংকীর্ণতা দূর করবে, এবং রৌদ্রের সময় পদ্মা তীরের উজ্জল দৃশ্যের মধ্যে আমার চোখের পরে বেড়িয়ে বেড়াবে। আজ সকাল বেলায় তাই গিরিবালা নাম্নী উজ্জ্বলশ্যামবর্ণ একটি ছোট অভিমানী মেয়েকে আমার কল্পনারাজ্যে অবতরণ করা গেছে। সবেমাত্র পাঁচটি লাইন লিখেছি এবং সে পাঁচ লাইনে কেবল এই কথা বলেছি যে কাল বৃষ্টি হয়ে গেছে, আজ বর্ষণ অন্তে চঞ্চল  মেঘ এবং চঞ্চল রৌদ্রের পরস্পর শিকার চলচে, হেনকালে পূর্বসঞ্চিত বিন্দুবিন্দু বারিশীকরবর্ষী তরুতলে গ্রামপথে উক্ত গিরিবালার আসা উচিত ছিল, তা না হয়ে আমার বোটে আমলাবর্গের সমাগম হল- তাতে করে সম্প্রতি গিরিবালাকে কিছুক্ষণের জন্য অপেক্ষা করতে হল। তা হোক তবু সে মনের মধ্যে আছে। দিনযাপনের আজ আর এক রকম উপায় পরীক্ষা করে দেখা গেছে। আজ বসে বসে ছেলেবেলাকার স্মৃতি এবং তখনকার মনের  ভাব খুব স্পষ্ট করে মনে  আনবার চেষ্টা  করছিলুম। যখন পেনেটির বাগানে ছিলুম, যখন পৈতের নেড়া মাথা নিয়ে প্রথমবার বোলপুরের বাগানে গিয়েছিলু্ম,‌ যখন পশ্চিমের বারান্দার সবশেষের ঘরে আমাদের ইস্কুলঘর ছিল, এবং আমিন একটা নীলকাগজের ছেঁড়া খাতায় বাঁকা লাইন কেটে বড় বড় কাঁচা অক্ষরে প্রকৃতির বর্ণনা লিখতুম, যখন তোষাখানার ঘরে শীতকালের সকালে চিন্তা বলে একটা চাকর গুনগুন স্বরে মধুকানের সুরে গান করতে করতে মাখন দিয়ে রুটি তোষ করত, - তখন আমাদের গায়ে গরম কাপড় ছিলনা, একখানা কামিজ পরে সেই আগুনের কাছে বসে শীত নিবারণ করতুম  এবং সেই  সশব্দবিগলিতনবনীসুগন্ধি রুটিখন্ডের উপরে লুব্ধদুরাশদৃষ্টি নিক্ষেপ করে  চুপ  করে  বসে চিন্তার গান শুনতুম - সেই সমস্ত দিনগুলিকে ঠিক বর্ত্তমানের করে দেখছিলুম এবং সেই সমস্ত দিনগুলির সঙ্গে এই রৌদ্রালোকিত পদ্মা এবং পদ্মার চর ভারী একরকম সুন্দরভাবে মিশ্রিত হচ্ছিল, -  ঠিক যেন আমার সেই ছেলেবেলাকার খোলা জানলার ধারে বসে এই পদ্মার একটি দৃশ্যখণ্ড দেখচি বলে মনে হচ্ছিল। তারপরে আমি ভাবলুম এই ত আমি কোন উপকরণ না নিয়ে কেবল গল্প লিখে এবং বর্ত্তমানকে দূরকালের সঙ্গে মিলিয়ে দিয়ে নিজেকে নিজে সুখী করতে পারি। তার পরেই মনে হল, প্রবাদ আছে “Nothing succeeds like success” – “টাকায় টাকা আনে” - তেমনি সুখও সুখ আনে। সুখের সময়েই আমরা মনে করি আমাদের সুখী হবার অসীম ক্ষমতা আছে - তারপরে দুঃখের সময় দেখতে পাই কোন ক্ষমতাই কোন কাজ করচে না, সব কলই একেবারে বিগড়ে গেছে। কাল বোধ হয় একটু কিছু সুখের আভাস মনের ভিতর রীরী করে উঠেছিল তাই সমস্ত কলগুলো একেবারে চলতে আরম্ভ করেছিল, জীবনের অতীতস্মৃতি এবং প্রকৃতির বর্ত্তমান শোভা একসঙ্গে সজীব হয়ে উঠেছিল‌, তাই সকালে আজ জেগে উঠেই মনে হল আমি কবি। যতই কবিত্ব থাক, যতই ক্ষমতার গর্ব করি মানুষ ভয়ানক পরাধীন। পৃথিবীর উপর থেকে এই কাঙাল জীবগুলো লম্বা হয়ে উঠে খাড়া হয়ে শীর্ণ হয়ে বেড়াচ্চে, -  আস্ত স্বর্গটি চায়, তারপরে টুকরোটাকরা  যা পায় তাতেই  ক্ষুধানিবৃত্তির চেষ্টা করে,  অবশেষে ভিক্ষাপ্রসারিত ঊর্ধ্বগামী দেহ  ধূলিলুণ্ঠিত হয়ে পড়ে এবং মৃত্যুকে স্বর্গপ্রাপ্তি বলে রটনা করে।  যেটুকু  সুখে জীবনের সমস্ত কলগুলো চলে সেইটুকু  সুখ যদি চিরকাল ধরে রাখা যায় তাহলে সমস্ত শক্তি বিকশিত সমস্ত কাজ সম্পন্ন করে যাওয়া যেতে পারে। আজ গিরিবালা অনাহুত এসে উপস্থিত হয়েছেন কাল বড় আবশ্যকের সময় তার দোদুল্যমান সূচ্যগ্রভাগটুকুও দেখা যাবে না। কিন্তু সে কথা নিয়ে আজ আর আন্দোলনের দরকার নেই। শ্রীমতি গিরিবালা তিরোধান সম্ভাবনা থাকে ত থাক- আজ যখন তাঁর শুভাগমন হয়েছে তখন সেটা আনন্দের বিষয় সন্দেহ নেই।

 এবারকার পত্রে অবগত হওয়া গেল যে আমার ঘরের ক্ষুদ্রতমাটি ক্ষুদ্র ঠোট ফুলিয়ে অভিমান করতে শিখেছে। আমি সে চিত্র বেশ দেখতে পাচ্চি। তার সেই নরম-নরম মুঠোর আঁচড়ের জন্যে আমার মুখটা নাকটা তৃষ্ণার্ত্ত হয়ে আছে। সে যেখানে-সেখানে আমাকে মুঠো করে ধরে টলমলে মাথাটা নিয়ে হাম করে খেতে আসত এবং ক্ষুদে ক্ষুদে আঙুলগুলোর মধ্যে আমার চষমার হারটা জড়িয়ে নিতান্ত নির্ব্বোধ নিশ্চিন্ত গম্ভীরভাবে গাল ফুলিয়ে চেয়ে থাকত সেই কথাটা মনে পড়ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ